মোহরাংকিত অন্তরের লক্ষণসমূহ

— উস্তাদ নোমান আলী খান

আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার সাত নম্বর আয়াতে বলেন – “আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।”

এখানে মোহর লাগানো অন্তর বলতে কোন অন্তরকে বুঝানো হয়েছে?

অন্তর হলো ভালোবাসার জায়গা। আল্লাহ যখন কারো অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন, সিল মেরে দেন তখন সে অন্তর সেসব জিনিসকে ভালোবাসতে অপারগ হয়ে পড়ে যেগুলো তার ভালোবাসার কথা ছিল। যেসব বিষয় ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তারা সেগুলো ঘৃণা করে। ঈমানদারদের ভালোবাসার কথা তাদের। কিন্তু তারা তাদের ঘৃণা করা শুরু করে। সত্যের প্রতি তাদের ভালোবাসা থাকার কথা, কিন্তু সত্যকে তারা ঘৃণা করা শুরু করে। ন্যায়কে তাদের ভালোবার কথা, কিন্তু ন্যায়কে তারা ঘৃণা করা শুরু করে। সুবহানাল্লাহ!

অন্তর হলো দয়ার জায়গা। কিন্তু অন্তরে যখন মোহর মেরে দেয়া হয়, তখন ‘রাহমা’ হারিয়ে যায়। এই মানুষগুলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর কথা বলতে পারে, নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে কারণ তাদের অন্তর মোহরাংকিত।

অন্তর হলো কৃতজ্ঞতার জায়গা। কৃতজ্ঞতা আসে অন্তর থেকে। যখন অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলোর অন্তরে কৃতজ্ঞতার কোনো অনুভূতি আর জাগ্রত হয় না। তারা কাউকে কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তারা মনে করে তাদের তো সব এমনিতেই পাওয়ার কথা।

অন্তর হলো ভয়ের জায়গা। যখন অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয় তখন তারা তাদের কর্মফলের কোন ভয় করে না।

অন্তর হলো প্রত্যাশার জায়গা। এই মানুষগুলো হতাশ। পরকালের ব্যাপারে তাদের কোনো আশা নেই। অন্য কারো ভালোর প্রতিও তাদের কোনো আশা নেই। তারা নিজেদের জন্যেও উন্নতির কোনো আশা করে না। তারা মনে করে সবকিছুই অর্থহীন। মন যা চায় তাই করো, কারণ যাই করো না কেন জীবন তো দুর্বিষহ এমনিতেই। এটাই তাদের মানসিকতা। তারা আশাহীন মানুষ, কারণ তাদের অন্তর তালাবদ্ধ।

অন্তর হলো অনুশোচনার জায়গা। যখন খারাপ কিছু করেন, তখন আপনার খারাপ অনুভব করার কথা। কারণ আল্লাহ মানুষের অন্তরে ”’নাফসে লাওয়ামা’ দিয়েছেন। যার কারণে আপনার অনুতাপ অনুশোচনা ফিল করার কথা। কিন্তু অন্তরে যখন মোহর মেরে দেয়া হয়, তখন সবচেয়ে জঘণ্য কাজ করার পরেও আপনি গর্ব অনুভব করতে পারেন। আল্লাহ বলেন – ” শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে।” (২৭:২৪)

অন্তর হল লজ্জা পাওয়ায় জায়গা। এই মানুষগুলোর কোনো লজ্জা শরম আর অবশিষ্ট নেই। যখন অন্তর মরে যায়, তখন তাদের কথা বার্তা, আচার আচরণ, জামা কাপড় যতই অশ্লীল, অমার্জিত আর কুরুচিপূর্ন হউক না কেন এতে তাদের কিছু যায় আসে না। আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিতে যে বিষয়গুলোকে বিশ্রী কদাকার করে দিয়েছেন, তারা সেগুলোকে নিজেদের জন্য সুন্দর বানিয়ে নেয়।

অন্তর হলো দায়িত্বানুভূতির জায়গা। আপনার প্রতিবেশীর প্রতি দায়-দায়িত্ব আছে, সন্তান-সন্ততির প্রতি দায়-দায়িত্ব আছে, স্বামী/স্ত্রীর প্রতি দায়-দায়িত্ত্ব আছে, পিতা-মাতার প্রতি রয়েছে, কিন্তু যখন অন্তর হয়ে পড়ে মোহরাঙ্কিত তখন দায়িত্বানুভূতির কোনো বালাই থাকে না আর সে অন্তরে।

অন্তর হলো আত্মমর্যাদার জায়গা। আমার মতে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করেছেন। এই মর্যাদাবোধ আসে অন্তর থেকে। যেমন, শিক্ষকের প্রতি আপনি যে মর্যাদা ফিল করেন তার অবস্থান অন্তরে। ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ (স) এর জন্য যে মর্যাদা অনুভব করেন তার অবস্থানও অন্তরে। আপনার নিজের প্রতিও নিজের যে সম্মান অনুভব করার কথা, তার অবস্থানও অন্তরে। কিন্তু অন্তরে যখন মোহর মেরে দেয়া হয় তখন সেখানে আর কোনো মর্যাদাবোধ অবশিষ্ট থাকে না। অন্য কারো জন্য নয়, এমনকি নিজের জন্যেও নয়। (অশ্লীলতা দেখলে আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে যায়।)

তাই, আল্লাহ যখন বলছেন, তিনি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন এটা কোনো ছোট সমস্যা নয়। ব্যাপারটা শুধু এমন নয় যে, তারা ঈমান আনবে না; বরং সকল ভালো গুণ যা অন্তর থেকে আসার কথা, হারিয়ে গেছে। সবকিছু, একজন মানুষের সম্পূর্ণ ফিতরাহ তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সুবহানাল্লাহ! এখানে যেন তেন মানুষ সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে না, এখানে কথা বলা হচ্ছে জঘণ্য চরিত্রের মানুষ সম্পর্কে।

এখন আয়াতটির প্রতি লক্ষ্য করুন। প্রথমে বলা হয়েছে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। তারপর বলা হয়েছে তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন। অন্তর যেহেতু ইতিমধ্যে মোহরাঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তাই তারা যাই শুনুক না কেন তাদের উপর এর আর কোনো প্রভাব পড়ছে না। কারণ, তারা যেটাই শুনুক তা কখনো অন্তরে গিয়ে পৌঁছায়নি। এরপর তিনি বলেন – তাদের চোখের উপর পর্দা পড়ে আছে।

এমনটি হয়, যখন তারা সত্যকে দেখতে অস্বীকৃতি জানায়, যখন তারা পথনির্দেশনা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, যখন তারা চারপাশের বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহ আমাদের এই সুন্দর দু’টি চোখ দিয়েছেন যেন আমরা এগুলো দিয়ে চারপাশের বাস্তবতা দেখি, আল্লাহর সৃষ্টি দেখি এবং মহাসত্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। যখন এই সামর্থ্যের অনুশীলন করতে ব্যর্থ হবেন, তখন আল্লাহ আপনাকে হয়তো তাঁর দানকৃত দুইটি চোখ দিয়ে এই পৃথিবী দেখার সুযোগ দিবেন কিন্তু তিনি এতে হেদায়েত দেখার সুযোগ দিবেন না।

আমাদের চারপাশে যা কিছুই আছে, যতোকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি বলেন – “ইন্না ফিই জালিকা লাআয়াতুন” এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে। যখন চোখের উপর পর্দা পড়ে যাবে, তখন আপনি হয়তো পাখি দেখবেন, গাছ দেখবেন, আকাশ দেখবেন কিন্তু তাতে আল্লাহর নিদর্শন চোখে পড়বে না। আপনি দেখবেন না এগুলো কিসের দিকে ইঙ্গিত করছে।