কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী নয় এইরকম একজন যুবক ভাই একদিন আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটা ছিল এইরকম – ‘আমি সবসময় ভালো করে কুরআন পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু এত চেষ্টা করার পরও আমি শুদ্ধ করে পড়তে পারি না’। যুবকের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সে খুবই আবেগী প্রকৃতির মানুষ। একদিন সে রেডিও তে কোন এক প্রোগ্রামে একটা ছোট বাচ্চার কুরআন তেলাওয়াত শুনছিল। সেই বাচ্চাটা এত সুন্দর করে পড়ছিল যে ওই প্রোগ্রাম এর শিক্ষক বলছিলেন, ‘সুবহানআল্লাহ! তোমার নফ্স, তোমার মন খুব পবিত্র। তুমি খুব পবিত্র। আর এই কারণে আল্লাহ তোমাকে এত সহজে, এত সুন্দর করে তেলাওয়াত করার ক্ষমতা দিয়েছেন’। তো এই কথা শুনে ওই যুবক চিন্তায় পড়ে গেল এবং ভাবতে লাগলো – আমি মনে হয় ভালো মানুষ না, এজন্যে আমি ভালো করে কুরআন পড়তে পারি না, আমার আত্মা পবিত্র না। এসব ভেবে সে মানসিকভাবে কষ্ট পেতে লাগলো। যদিও আমি নিশ্চিত ওই রেডিও প্রোগ্রামের শিক্ষক এইরকম কিছু বোঝাতে চান নি, তিনি নিছক সেই বাচ্চা ছেলেকে উংসাহ দেয়ার জন্য এইরকম কিছু বলেছিলেন।
এই প্রেক্ষিতে আসুন আমরা একটা হাদিস দেখি, রাসুল (স) বলেছেন ‘কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী ব্যক্তিরা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। কিন্তু যারা উচ্চারণগত বা অন্য কোন সমস্যা থাকা সত্বেও কষ্ট করে পড়ার চেষ্টা করে, তারা এর দ্বিগুন পুরস্কার পাবে। (সহি মুসলিম)’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঐসব লোক কাদের তুলনায় এই দ্বিগুন পুরস্কার পাবে? সাধারণ তেলাওয়াতকারীদের তুলনায়? নাকি তেলাওয়াতে পারদর্শিদের তুলনায়? আমার মতে তেলাওয়াতে পারদর্শীদের তুলনায় এই দ্বিগুন পুরস্কার দেয়া হবে। কারণ একজন মানুষ কতটুকু অর্জন করলো আল্লাহ সেটাকে গুরুত্ব দেন না, আল্লাহ গুরত্ব দেন সে কী পরিমান চেষ্টা করলো সেটাকে। আমরা মানুষরাই অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেই, সবসময় দেখতে চাই ফলাফল কি, লাভ কতটুকু হলো? আমরা কতটুকু জানি, কতটুকু মুখস্ত করলাম, কতটুকু পড়লাম এই ধরনের সহজে পরিমাপ করা যায় এমন বিষয়ের দিকেই বেশি গুরত্ব দেই, কারণ এইসব দেখা যায়। কিন্তু আল্লাহ এইসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করেন না, তিনি দেখেন আমরা কী পরিমাণ চেষ্টা করলাম। উদাহরনস্বরুপ মনে করুন, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এক ব্যক্তি এক লক্ষ টাকা দান করলেন। বেশ একটা বড় পরিমান টাকা! কিন্তু অপর একজন, খুবই গরীব, সর্বসাকুল্যে তার কাছে একশ টাকা আছে আর সে এর অর্ধেক, পঞ্চাশ টাকা দান করে দিল। এই পঞ্চাশ টাকার মূল্য আল্লাহর কাছে সেই এক লক্ষ টাকার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, দানের পরিমানের চেয়ে দানের প্রকৃতি (গুণমান) এখানে আল্লাহর কাছে বেশি গুরত্বপূর্ন।
এই একই বিষয় প্রযোজ্য চেষ্টার ক্ষেত্রে। আপনি কুরআন তেলওয়াতে পারদর্শী না, এর মানে এই না যে আপনি একজন খারাপ মানুষ। মূল বিষয় হচ্ছে আপনি চেষ্টা করছেন, আপনি প্রতিটা শব্দ বুঝার জন্য কষ্ট করছেন। আল্লাহই আপনাকে এই চেষ্টার মধ্যে ফেলেছেন। আল্লাহ চাইলেই আপনার জন্য এটা সহজ করে দিতে পারতেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলেই মুসা (আ) তোতলামি ব্যতীত স্পষ্ট করে কথা বলতে পারতেন এবং ফেরাউন এই কথা বলার সুযোগ পেত না যে ‘সে (মুসা (আ )) তো ঠিকমত কথা ই বলতে পারে না!’ মানুষের জীবনে নানা ধরনের সমস্যা আছে; কারো শারীরিক অক্ষমতা, কারো মানসিক সমস্যা, কারো বা অন্য কোনো সমস্যা। এইসব সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আমরা জানি না কেন এইরকম হয়, কিন্তু এর মানে এই না যে আল্লাহ সেইসব মানুষকে অভিশাপ দিয়েছেন। অথবা তারা আমাদের চেয়ে নিন্মমানের। বরং এমন ও হতে পারে যে এইসব সমস্যা থাকার কারণেই তারা আমাদের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান। হয়তোবা এসব সমস্যার কারণে তারা এমন পর্যায়ের সম্মানিত হবে, যে পর্যায়ে আমরা কখনোই যেতে পারব না। আমাদের কে এইকারণে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর বিচারের মাপকাঠি, আর আমাদের মাপকাঠি একই নয়।
আমার আরবী ক্লাস এর একটা ঘটনা: আপনারা জানেন ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের যাচাই করা হয় তারা কতটুকু জানে তার উপরে ভিত্তি করে, কে কত ভালো বলতে পারে, পড়তে পারে, কার গ্রামার কত ভালো, এইসব হচ্ছে মাপকাঠি। তো আমার একটা ছাত্র ছিল, অন্য সব কাজেই সে খুবই মেধাবী, নিজের পেশাগত জীবনে সে খুব সফল, মোটামুটি সে যা কিছুই করত বলা যায় যে সবকিছুতেই সফল হত। কিন্তু আরবী শেখার বেলায় তার অবস্থা খুবই করুন। এমনকি পরীক্ষায় ত্রিশ পাওয়াই তার জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও সে অন্য যে কোন ছাত্রের তুলনায় অনেক বেশি পড়াশোনা করে। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন সে পড়ালেখা করে। সাধারণ কোনো ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করলে এর পরের কয়েকদিন মন খারাপ করে পড়ালেখা বন্ধ করে রাখে। কিন্তু আমার এই ছাত্র তার সব ভুলগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে, আবার ঠিক করে। সে অনেকটা আমার বন্ধুর মতো, দিনের বেলা আমি তার শিক্ষক। কিন্তু, রাতে মাঝে মাঝে আমি যদি কখনো তাকে বলি যে চলো ঘুরে আসি, সে আমাকে বলে – ‘না, না , আমাকে পড়তে হবে।’ সে যদিও অন্য অনেক ছাত্রদের মতো ভালো নম্বর পায় না, কিন্তু আমি তাকে অন্যদের চেয়ে অনেক শ্রদ্ধা করি। আমি জানি যে আল্লাহ তাকে অনেক ভালো প্রতিদান দিবেন। কারণ , কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই যে কষ্ট, এই যে চেষ্টা, এটাকেই আল্লাহ গুরুত্ব দেন। মাঝে মাঝে আল্লাহ আমাদের বিপদে ফেলেন, আর এই বিপদের ফেলার মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের আরো উন্নত মর্যাদা দান করেন।
তাই মানুষ আপনাকে নিয়ে কী ধারণা করলো, বা অন্যের তুলনায় আপনি কতটুকু জানেন বা কতটুকু করতে পারেন, এই বিষয়কে আল্লাহ আপনার বিষয়ে কী ধারণা করেন এর সাথে তুলনা করবেন না। ‘আল্লাহর কাছে সেই সবচেয়ে ভালো যার তাকওয়া সবচয়ে বেশি।’ আর আপনার তাকওয়া অন্য কোনো মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না। আমি দোয়া করি, আমরা যাতে অন্যদের সমালোচনার দৃষ্টিতে না দেখি। বিশেষ করে আমরা যেন নিজদের ব্যাপারেও এইরকম সমালোচনা না করি। আমরা যেন নিজেদেরকে সারাক্ষণ অন্যের সাথে তুলনা করে বিচার না করি। ( আমিন )”
— উস্তাদ নোমান আলী খান