উস্তাদ নোমান আলী খান
(সূরা আলাম নাশরাহ এর তাফসীর)
১। আজকের খুতবাহ কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে। যা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা দুইবার উল্লেখ করেছেন সূরা ইনশিরাহ এর মাঝখানে, একে সূরা শার’ও বলা হয়। আল্লাহ বলেছেন – ” ফাইন্না মা’য়াল উস্রি ইয়ুস্রা, ইন্না মা’য়াল উস্রি ইয়ুস্রা।” সাধারণত এর অনুবাদ করা হয় – “কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে, নিঃসন্দেহে কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।” এই আয়াতের এটাই গড়পড়তা অনুবাদ। তবে, সবার আগে কীভাবে ছোট ছোট সূরাগুলোর কদর করতে হয় সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
আপনাদের অনেকেই এই সূরাটি মুখস্ত করেছেন, আপনাদের বাচ্চারাও হয়তো মুখস্ত করেছে। এটা আমাদের ধর্মের খুবই সুন্দর একটি শিক্ষা এবং আমাদের জীবনের জন্যেও সুন্দর একটি শিক্ষা। আল-কুরআনের কিছু কিছু ছোট সূরার মাঝে গভীরতম শিক্ষা লুকিয়ে আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞা থেকে সূরাগুলোকে সংক্ষিপ্ত রেখেছেন যেন মানুষ সহজেই এগুলো মুখস্ত করতে পারে। এবং এগুলো থেকে জীবনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু শিক্ষা সহজে মনে রাখতে পারে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এমন একটি সময়ের কথা বর্ণনা করছেন যখন রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর জীবনের কঠিন একটি সময়কাল অতিবাহিত করছিলেন। প্রথমদিকে তিনি যখন দীনের দাওয়াত প্রচার করে যাচ্ছিলেন, বেশিরভাগ মানুষ এই দাওয়াত শোনার প্রতি আগ্রহী ছিল না। আমাদের সময়কালের মত সময় সেটা ছিল না। সেই সময়টা হুদায়বিয়ার সন্ধি পরবর্তী সময়কালের মতও ছিল না, যখন দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল।
নবুয়তী মিশনের প্রথম দিকে মানুষ তাঁর জন্য কাজটা অনেক কঠিন করে তুলেছিল। যে কেউ রাসুলুল্লাহ (স) এর দাওয়াত গ্রহণ করতো, তাকে পাগল আখ্যা দেয়া হত, সুফাহা তথা বোকা এবং বুদ্ধিহীন বলা হত, অথবা বলা হত তিনি এদেরকে বোকা বানিয়েছেন। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তাকে এই সমস্ত অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত। সেই সময় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই গভীর অর্থপূর্ণ সূরাটি নাজিল করেন। এবং তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন আল্লাহ সর্বদা তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করে যাচ্ছেন। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরণের অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য একটি সূরায় তিনি বলেন – “আলাম ইয়াজিদকা ইয়াতিমান ফাআ-ওয়া।” “আল্লাহ কি আপনাকে ইয়াতিম হিসেবে পাননি? অতঃপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন।” “ওয়াওয়াজাদাকা দ-ল্লান ফাহাদা-, ওয়াওয়াজাদাকা আ’-ইলান ফাআগনা-।” আল্লাহ বলেন – “তিনি আপনাকে পথ খুঁজতে থাকাবস্থায় পেয়েছেন এবং তিনি আপনাকে পথ দেখিয়েছেন।” তিনি আরও বলেন – “তিনি আপনাকে নিঃস্ব পেয়েছেন এবং তিনি আপনাকে সম্পদশালী করে দিয়েছেন।” অর্থাৎ খাদিজা (রা) এর সাথে বিয়ের মাধ্যমে। এর পর অর্থনৈতিকভাবে আপনাকে আর কারো উপর নির্ভর করতে হয়নি।
কিন্তু এই সূরায় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা ভিন্নরকম একটি অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন। আসলে আরও গভীর একটি অনুগ্রহ। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন – “আলাম নাশ্রাহ লাকা সদ্রাক” আমি কি আপনার জন্য আপনার বক্ষ সম্প্রসারিত করিনি? আরবি ভাষায় বক্ষ সম্প্রসারণ মানে প্রশান্তিতে থাকা, শান্ত থাকা।
রাসুলুল্লাহ (স) সহজ কোন পরিস্থিতিতে ছিলেন না। তাঁর আশেপাশের সবাই হয় তাঁর বিরুদ্ধে সমানে অভিযোগ করে যাচ্ছিল, নয়ত তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে চাইতো। তাঁর নিজের গোত্রের লোকজনও তাঁকে পরিত্যাগ করে চেয়েছিল। কোন কিছুই সহজ ছিল না। তবু আল্লাহ বলেছেন এই সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনার প্রতি সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হল আপনার বক্ষ সম্প্রসারিত করা হয়েছে। আপনার অন্তরে শান্তি দেয়া হয়েছে। আপনি প্রশান্তিতে আছেন।
তারপর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বর্ণনা করেন কিসের শান্তি? “ওয়া ওয়া দ’না ‘আনকা বিজ্রাক” তিনি বোঝা দূর করে দিয়েছেন। এই আয়াতে বোঝা বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে ওলামারা অনেক মন্তব্য করেছেন। আমি তার থেকে একটি ব্যাপার আজকের খুৎবায় আলোচনা করবো।
রাসুলুল্লাহ (স) নবুয়ত লাভ করার পূর্বে মক্কা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতেন এবং পৃথিবীতে কেন এতো দুঃখ-কষ্ট তা নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকতেন। তিনি (স) ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের বেলা কখনো কখনো রাতেও চিন্তামগ্ন অবস্থায় হেরা গুহায় কাটিয়ে দিতেন। তিনি সমাজ থেকে নিজেকে এভাবে দূরে সরিয়ে নিয়ে ভাবতেন এই জীবনে কেন এতো দুঃখ, যাতনা। আর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাঁর নিজের কথার মাধ্যেম। যখন রাসুলুল্লাহ (স) আল্লাহর কালামের মাধ্যমে জবাব পেলেন, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই ব্যাপাটাকে বর্ণনা করছেন যে, তিনি আপনার বোঝা লাঘব করে দিয়েছেন। “ওয়া ওয়া দ’না ‘আনকা বিজ্রাক”
আমাদের জন্য এতে শিক্ষা হল, হ্যাঁ জীবনে অনেক চাপ সইতে হয়। আর আল্লাহ বলছেন তাঁর কালাম এই চাপ থেকে নিষ্কৃতি দান করে। ঐ বোঝাগুলো দূর করে দেয়। “আল্লাজি আনকাদা জহরাক, ওয়ারাফা’না লাকা জিক্রাক। “যা আপনার পিঠ ভেঙ্গে দিচ্ছিল। আর আমি আপনার (মর্যাদার) জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।”
এই সূরায় যে শিক্ষাটি আল্লাহ দান করেছেন তা শুধু রাসুলুল্লাহ (স) এর জন্য নয়। এটি আসলে সকল মানুষের জন্য। فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا – এর সাধারণ অনুবাদ হল – “নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।”
আজকের খুৎবার কিছুটা সময় আমি এই আয়াতের উপর ব্যয় করবো এবং জানার চেষ্টা করবো যে আমার আপনার জন্য এই আয়াতে কী শিক্ষা রয়েছে। প্রথমে এই আয়াতের আরবি ব্যাকরণগত দিক আলোচনা করতে চাই। আপনাদের মাঝে যারা আরবি ব্যাকরণের সাথে পরিচিত তাদের জন্য বলছি – এখানে মুব্দাতা হল ‘ইউসুর।’ ব্যাকরণগত দিক থেকে এই বাক্যের শুরু হল, স্বস্তি। যখন আমরা বংলায় অনুবাদ করি তখন বলি – ”নিশ্চয় সকল কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।” কিন্তু ব্যাকরণগত দিক থেকে সবচেয়ে শুদ্ধ অনুবাদ হল, “স্বস্তি রয়েছে কষ্টের সাথে।” বাক্যের ফোকাস হল ‘স্বস্তির’ উপর, ‘কষ্টের’ উপর নয়। এখানে ইউসুর বা স্বস্তি হল মুবতাদা। ব্যাকরণগত দিক থেকে এটাই বাক্যের শুরু।
এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, আল্লাহ আমাদের মনোযোগ স্বস্তির উপর রাখতে চাচ্ছেন কষ্টের উপর নয়। সহজ সময় বা স্বস্তি হয়তো পরে একসময় আসবে। কিন্তু আল্লাহ চান আমরা যেন আমাদের মনোযোগ সামনে যে স্বস্তিদায়ক সময় আসছে তার উপর রাখি। এখন যে কষ্টে আছি তার উপর নয়। আপনি যে ধরণের কঠিন সময়েই দিনাতিপাত করছেন না কেন আল্লাহ এর একটা ব্যবস্থা করবেন এবং স্বস্তিদায়ক সময় সামনে অবশ্যই আসছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা এখানে মনোযোগের দাবি রাখে তা হল, ‘ইউসুর’ না-কেরা। মানে এটি আআ’ম, ওয়া আস্মাল, ওয়া আ’জাম, ওয়া আ’কাদ। অর্থাৎ, কষ্ট কী এটা সবাই জানে। হয়তো এটি অর্থনৈতিক কষ্ট, স্বাস্থ্যগত কষ্ট, মানসিক কষ্ট, আবেগ সংক্রান্ত কোন কষ্ট, বা আপনার কষ্টের জিনিস হয়তো আপনার পাশেই বসে আছে, আমি জানি না। সবারই জীবনে কোন না কোন সমস্যা রয়েছে। এই কষ্টদায়ক বিষয়গুলো সম্পর্কে সবাই জানে। আর এগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট।
কিন্তু আল্লাহ বলছেন কষ্টের চেয়ে স্বস্তিটা অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত। কষ্টের মত স্বস্তির ব্যাপারটা অতটা জ্ঞাত নয়। অর্থাৎ, কিছু স্বস্তি আসবে কিন্তু আপনি জানেন না কীভাবে সেটা চিনতে হয়। সবাই সমস্যা শনাক্ত করতে পারে কিন্তু সবাই সমাধান দিতে পারে না। আল্লাহ যখন আপনাকে স্বস্তি দিবেন আপনি হয়তো এটাকে স্বস্তি মনে নাও করতে পারেন। আল্লাহ আপনার জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসবেন কিন্তু আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না যে আল্লাহ আপনার জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসছেন।
তিনি আপনার জীবনে এমন দিক থেকে স্বস্তি নিয়ে আসবেন যা সম্পর্কে আপনি জানতেন, আবার এমন দিক থেকেও নিয়ে আসবেন যা সম্পর্কে আপনি ভাবতেও পারেননি, জানতেনও না। যা ছিল অদৃশ্য জগতের কারবার, অপ্রকাশ্য জগতের কারবার। ‘ইন্না মা’য়াল উসরি’ বাক্যাংশে ‘আল উসর’ অর্থ কষ্টটি। অর্থাৎ এটি সুনির্দিষ্ট, জ্ঞাত। পরের শব্দ ‘ইউসরান’ হল না-কেরা বা অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ স্বস্তির ব্যাপারটা অজানা। এটা আমাদের কাছে একটি রহস্য।
ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক সময় মানুষ কেবল সে বিষয়ের উপর ফোকাস করে যা দেখা যায়। আর তারা যা দেখে তা হল, সমস্যা। তারা যা দেখতে পায় না তার প্রতি কোন মনোযোগ দিতে পারে না। এখন আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন অদৃশ্য স্বস্তি বা আরাম তোমাদের জন্য আসছে সবসময়। এই অদৃশ্য স্বস্তি সবসময় বর্তমান আছে।
আরবি ‘ইন্না’ শব্দের অর্থ নিশ্চয়। ভাষাবিদরা ‘ইন্নাকে’ বর্ণনা করেছেন ‘হারফুন লিইজালাতিস সাক’ অর্থাৎ, ইন্না বাক্যে ব্যবহৃত হয় সন্দেহ দূর করতে। একটি সহজ উদাহরণ দিচ্ছি – আপনি যদি কোন সমস্যায় পতিত হন… ধরুন, সমস্যাটা দেখা দিয়েছে চাকরির কাজে বা পরিবারে।
এখন কেউ এসে বলল, আরে ভাই, এটা কোন সমস্যাই না।
আপনি বললেন, না, এটা একটা বিশাল সমস্যা।
অর্থাৎ সমস্যাটা সম্পর্কে আপনার মনে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাধান নিয়ে সন্দেহ আছে। সমস্যাটা কি কোনদিন শেষ হবে এই বিষয়ে আপনার সন্দেহ রয়েছে। সহজ সময় কি কোনদিন আসবে? কোন সমাধান আসলেই কি আসবে? এই বিষয়ে আপনি সন্দিহান।
সুতরাং, সমস্যার ব্যাপারে মানুষ পুরোপুরি নিশ্চিত থাকে। কিন্তু সমাধান আসবে কিনা এই ব্যাপারে তারা সন্দেহপ্রবন। সহজেই আমরা আশাহীন হয়ে পড়ি। আমরা চিন্তা করতে থাকি – “ভাই এটা সবসময় এমন খারাপই থাকবে। কোন দিন এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এটা কোন দিনও সহজ হবে না, তাই না?” আমরা এভাবে নিজেদেরকে বলি। তো, আমরা নেগেটিভের ব্যাপারে অনেক বেশি নিশ্চিত থাকি কিন্তু পজিটিভের ব্যাপারে নিজের মনে কোন নিশ্চয়তা থাকে না।
আল্লাহ এই আয়াতে কী করলেন? তিনি ‘ইন্না’ যে শব্দটি সন্দেহ দূর করে তা ব্যবহার করে আমাদের জানাচ্ছেন, কোন সন্দেহ নেই স্বস্তি রয়েছে কষ্টের সাথে। আল্লাহ ‘ইন্না’ নিশ্চয়তা প্রদানকারী শব্দটি কষ্টের সাথে নয়, স্বস্তির সাথে ব্যবহার করলেন। তিনি স্বস্তির উপর জোর দিলেন।
যেন একজন মুমিন যখন এই আয়াত তিলাওয়াত করবে সে মনে করবে আমার কষ্টের ব্যাপারে সন্দেহ থাকতে পারে … আমি সমস্যাটাকে যতটা বড় মনে করছি এটা আসলে ততটা বড় সমস্যা নয়। কিন্তু আল্লাহ যে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসছেন তা অনেক বড় এবং নিঃসন্দেহে তা আসছে। তার আগমন সন্দেহাতীত।
এটা আমাদেরকে মন্দের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবন করে তোলে। মাঝে মাঝে কোন কিছু হয়তো অনেক খারাপ মনে হতে পারে আমাদের মাথায়, আমাদের চিন্তায় এবং আমাদের অনুভূতিতে। কিন্তু বাস্তবে তা এতো খারাপ নয়। কিছু মানুষ কোন একটা সমস্যাকে তার চিন্তায় বড় থেকে বড়, আরও বড় করে তোলে। শেষে তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে আশেপাশের মানুষের সাথে যদি সমস্যাটা নিয়ে কথা বলেন, তারা এটাকে ছোট করে দেখার পরিবর্তে আরও বড় করে তোলে।
তখন সমস্যাটাকে তার আসল অবস্থার চেয়ে অনেক বিশাল মনে হয়। আর যে স্বস্তি আল্লাহ নিয়ে আসছেন তা আপনার সামনেই বর্তমান, কিন্তু আপনি তা দেখছেন না। কারণ সমস্যাটাকে আপনি কাল্পনিক দৃষ্টিতে অনেক বড় করে দেখছেন। তাই আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলছেন স্বস্তি আসার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো। আল্লাহ যে স্বস্তি নিয়ে আসছেন এ ব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ পোষণ করো না।
২।
এই আয়াতের শেষ যে শিক্ষাটি আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই – সূরাটি শেষ করার পূর্বে এবং শেষ অংশটি কীভাবে এই অংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা আলোচনা করার পূর্বে – তা হল, আল্লাহ বলেনেনি কষ্টের পর স্বস্তি আসে। তিনি ‘পর’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছেন ‘সাথে’ শব্দটি। তিনি বলেছেন – ”ইন্না মা’য়া, আল উস্রি ইউস্রা” তিনি ‘ইন্না বা’দাল উস্রি ইউস্রা’ বলেননি। ‘সাথে’ এবং ‘পর’ শব্দের মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এখানে বড় পার্থক্য রয়েছে ‘ কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে’ এবং ‘কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে’ বলার মাঝে। বড় ফারাক রয়েছে। আমি এই খুৎবায় অন্তত দুইটি পার্থক্য আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
একটি পার্থক্য হল – হয়ত আপনি যখন একটি সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন, সেই সমস্যাটি সাথে কিছু স্বস্তির বিষয়ও আপনার জীবনে নিয়ে এসেছে, যা এমনকি আপনি উপলব্ধিও করতে পারেননি। একই সময়ে। বর্তমান সমস্যাটি যতটা কঠিন মনে হউক না কেন, বিকল্প হয়তো আরও অনেক বেশি কঠিন হত। হয়তো একটি দরজা বন্ধ হওয়ার কারণে আরও পাঁচটি দরজা খুলে গিয়েছে। আপনি ব্যাপারটি দেখতে পাননি। কিন্তু আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার ডিজাইনে একটি সমস্যা হয়ত আরও কুড়িটি সমাধানের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আরও অগণিত সমাধানের পথ খুলে দেয়। তাই ঐ স্বস্তিদায়ক বিষয়গুলো আসার জন্য এই সমস্যাটি ঘটার দরকার ছিল। এটি আল্লাহর সুবিজ্ঞ ডিজাইনের অংশ। আমরা হয়তো তা শনাক্ত করতে পারি না। কিন্তু এটা সবসময় থাকে।
অন্য কথায়, হ্যাঁ আমার মন বলছে আমি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু এই সমস্যার মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমার জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসছেন নিশ্চিতভাবেই, আমাকে শুধু সেটা খুঁজে পেতে হবে। সমস্যা আমি দেখতে পারছি, কিন্তু সমাধান কোথায় সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। জীবনে আমরা যত ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই, তখন আমরা এভাবে প্রশ্ন করি – “আমাকে কেন এই বিপদে ফেলা হল? আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে? আমি কি এমন অন্যায় করেছি? এর থেকে ভালো কী আসবে?” আপনাদের বলছিঃ ঐ অভিজ্ঞতাগুলোর প্রত্যেকটাই কোন না কোন সহজতা, স্বস্তি বা ভালো সাথে করে নিয়ে আসে যা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু আল্লাহ বলছেন ঐ স্বস্তি সাথেই আছে। তোমাকে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এটা একই সময়ে কষ্টের সাথে সহাবস্থান করে। একই সময়ে কষ্টের সঙ্গেই এই স্বস্তির অবস্থান। “ইন্না মা’য়াল উস্রি ইউস্রা।”
এছাড়াও, যখন ‘সাথে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, আল্লাহ বলছেন যে স্বস্তিকে কষ্টের সাথে রাখা হয়েছে। স্বস্তিকে কষ্টের সাথে রাখা হয়েছে। যেভাবে তিনি রাতকে দিনের সাথে রেখেছেন। তিনি যেভাবে মেঘমালাকে বৃষ্টির সাথে রেখেছেন। অনেক জিনিস আছে যেগুলো তিনি একত্রে রেখেছেন। এই জীবনে আল্লাহ যা করার সিদ্ধান্ত নিলেনঃ আমি আর আপনি যদি স্বস্তি পেতে চাই, তিনি ব্যাপারটাকে এমনভাবে ডিজাইন করলেন, আপনাকে এর জন্য প্রথমে কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
কষ্টের মধ্য দিয়ে গেলেই কেবল কষ্টের সাথে স্বস্তি আসবে। এভাবেই তিনি জীবনের সব কিছু ডিজাইন করেছেন। আপনাদের অনেকেই ছাত্র। আপনাকে প্রথমে পড়া-লেখার কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে; তারপর আপনি গ্রাজুয়েট হওয়ার স্বস্তি লাভ করবেন, পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ন হওয়ার স্বস্তি লাভ করবেন। আপনার চাকরির জায়গায় কঠিন পরিশ্রম করতে হবে; বোনাসের স্বস্তি লাভ করার পূর্বে, প্রমোশন লাভ করার পূর্বে। কষ্ট ছাড়া এসব ঘটবে না। আপনাকে আগে খাদ্যাভ্যাস ঠিক করতে হবে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে; ভালো সাস্থ্য লাভ করার পূর্বে।
কোনো রোগীকে হয়তো আগে অপারেশনের কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সুস্থ্য হওয়ার আনন্দ উপভোগ করার পূর্বে। এভাবেই আল্লাহ জীবনকে তৈরী করেছেন। আপনাকে কষ্টকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে যদি স্বস্তি লাভ করতে চান। এটাই আল্লাহর ডিজাইন। ব্যাপারটা এমনই।
আপনি একথা শোনার পর হয়তো ভাবতে পারেন, “আমি তো এখন কঠিন সময়ে আছি, তারমানে সামনে সহজ সময় আসছে। আর তাই আমি এখন বিশ্রাম করবো আর এর আগমনের অপেক্ষায় থাকবো।” না, আল্লাহ আমাদেরকে গভীর একটি বিষয় সম্পর্কে জানাচ্ছেন। আপনাকে কঠিন সময়ে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে, কাঠিন্যের সাথে ফাইট করে যেতে হবে। বসে বসে এমনটি ভাবলে হবে না – “আল্লাহ তো সহজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাই আমি তার অপেক্ষায় থাকবো আর বসে বসে কাঁদবো।”
এ জন্যই তিনি পরের আয়াতে আমাদের রাসূল (স) কে বলেছেন: فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ – খুবই শক্তিশালী বাক্য। অর্থঃ “অতএব, যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন।” স্বস্তি এবং কষ্টের সাথে এর সম্পর্ক কী? আল্লাহ চান না আমি আর আপনি যেন অলস হয়ে বসে থাকি। যখন আমরা কোনো কঠিন সময়ে থাকি, তখন আল্লাহ চান আমরা যেন প্রচুর পরিশ্রম করি।
অন্য মানুষদের দেখবেন যখন তারা কোনো কঠিন সময়ে পতিত হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একেবারে হতাশ হয়ে বসে থাকে। তারা নিরাশ হয়ে পড়ে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং সব কিছু বাদ দিতে শুরু করে। কিন্তু বিশ্বাসীদের বেলায়, যখন তুমি কঠিন কোনো পরিস্থিতিতে পড়, তখন ফ্রী সময় পেলেই নিজেকে কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত কর। নিজেকে কাজে লাগাও, উৎপাদনক্ষম বানাও। উলামারা এই আয়াত নিয়ে প্রচুর মন্তব্য করেছেন।
যখন দাওয়ার কাজ থেকে অবসর পান, তখন নিজেকে ইবাদাতের কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত করুন। ইবাদাত থেকে অবসর পাওয়ার পর দাওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করুন। রাসূলুল্লাহ (স) কে বলা হচ্ছে এক কাজ থেকে অবসর পাওয়ার পর অন্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলুন।
আমার আর আপনার জন্য প্রশ্ন হলো, কত সময় আমরা অপচয় করি এমনটা ভেবে যে জীবন কত দুর্বিষহ? অলস হয়ে বসে থাকি কিছুই করি না। নিজের মনকে নেগেটিভ চিন্তায় ডুবিয়ে রাখি। সম্পূর্ণ অকার্যকর আর অকর্মণ্য হয়ে বসে থাকি। আর আল্লাহ বলছেন তোমার হাতে অনেক বেশি ফ্রী সময় আছে আর তুমি এই সময় কোনো কাজেই লাগাচ্ছ না। যখন আপনি নিজেকে কোনো পরিশ্রমে নিয়োজিত না করেন, তারমানে আপনি কষ্টকে জেতার সুযোগ দিচ্ছেন। আয়াতটি শুরু হয়েছে ‘ফা’ অক্ষর দিয়ে। বাক্যে ‘ফা’ এর এমন প্রয়োগকে বলা হয় “ফা আস সাবাবিইইয়া।” অর্থাৎ, অতএব। তুমি যেহেতু স্বস্তি কামনা করো তাই তোমার নিজেকে পরিশ্রমে নিয়োজিত করতে হবে। এটা শেখার ফলে তোমার উচিত নিজেকে পরিশ্রমে নিয়োজিত করা। তাই, আমার আর আপনার উচিত একটি অর্থপূর্ণ এবং প্রডাক্টটিভ জীবন যাপন করা।
মাঝে মাঝে জীবনে অতিরিক্ত চাপের কারণে আমরা হতচকিত হয়ে পড়ি। তখন আমরা সহজেই একেবারে ভেঙ্গে পড়ি দুঃখ-হতাশায়, উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠায়। এরকম হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু আমাদেরকে শিখতে হবে কীভাবে আমরা আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে এই কষ্টকর অভিজ্ঞতায় মানসিক শক্তি অর্জন করবো, নিজেদেরকে কাজে নিয়োগ করবো এবং ব্যস্ত করে তুলব।
রাসুলুল্লাহ (স) যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখতেন তা ছিল দুই প্রকার। দয়া করে মনে রাখুন। দুই ধরণের কাজ আছে যা আপনাকে ব্যস্ত করে রাখতে পারে। আমি আমাদের জন্য তৃতীয় আরেকটি যুক্ত করবো। রাসুলুল্লাহ (স) হয় এমন কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে যা আল্লাহকে খুশি করতো, অথবা তিনি এমন কোন কাজে ব্যস্ত থাকতেন যা আল্লাহর কোন সৃষ্টির উপকার করতো। তিনি হয় শুধু আল্লাহর জন্য কিছু করতেন যেমন, নামাজ পড়া, জিকির করা। এই কাজগুলো ছিল শুধু আল্লাহর জন্য। অথবা তিনি কাউকে সাহায্য করতেন। তিনি কাউকে পথ দেখাতেন, শিক্ষা দিতেন। এমনকি তিনি মানুষকে জীবিকা উপার্জনের জন্যেও সাহায্য করতেন। এভাবে তিনি অন্য মানুষদের সব ধরণের সাহায্য করতেন।
এখন আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই দুই ধরণের কাজের কোনটি আপনি করছেন? কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন? আমি কি এমন কিছু করছি যা আল্লাহকে খুশি করছে? বা আমি কি এমন কিছু করছি যা কারো জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসছে? বস্তুত, আল্লাহ অন্য একটি সূরায় রাসুলুল্লাহ (স) কে এই কাজগুলো সম্পর্কে বলেছেন। তিনি বলেন – فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ – সুতরাং আপনি এতীমের প্রতি কঠোর হবেন না – وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ – আর ভিক্ষুককে তুমি ধমক দিবেন না। وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ – এবং আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। (৯৩ঃ ৯-১১)
কেন আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (স) কে এসব কথা বলেছেন? আপনি ইয়াতিম ছিলেন, এখন যান ইয়াতিমের দেখাশোনা করুন। আপনার টাকাপয়সা ছিল না, এখন যান যাদের টাকা পয়সা নেই তাদের সাহায্য করুন।
তাই আমাদেরকেও হয় এমন কিছুতে ব্যস্ত থাকতে হবে যা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলে, অথবা এমন কিছুতে ব্যস্ত থাকতে হবে যা অন্যদের জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসে। এভাবে যখন আপনি আল্লাহর অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন এবং যখন আপনি অন্যদের জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসার জন্য কাজ করবেন; তখন আল্লাহ আপনার জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসবেন।
কিন্তু আপনি যখন অতিরিক্ত চিন্তা করতে থাকবেন নিজের সমস্যাগুলো কতটা খারাপ, জীবনটা কেমন দুর্বিষহ, কীভাবে সবকিছু তার গতিপথ হারিয়ে ফেলছে, কোন কিছুই কোনদিন ঠিক হবে না, তাহলে নিজের মাঝে আপনি অতিরিক্ত ডুবে আছেন। আপনি নিজেকে নিয়েই পড়ে আছেন।
এভাবে নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকলে আল্লাহর সাহায্য আসে না। এভাবে আল্লাহর সাহায্য আসে না। তিনি বলেন – وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَارْغَب – “এবং আপনার পালনকর্তার প্রতি মনোনিবেশ করুন।” (৯৪:৮)
আমি আর আপনি যে সমস্যাগুলোর মাঝে দিন পার করছি, আজ সেগুলোকে অনেক বেশি বড় বলে মনে হয়, সমস্যা ছাড়া আর কিছু নিয়ে আমরা ভাবতেই পারি না। কিন্তু একটু সামনে এগিয়ে চিন্তা করলে বুঝবেন, আমরা সবাই একটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলছি। প্রতিদিন একটু একটু করে সেই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছি। আর সেই গন্তব্যটি হল, আল্লাহর সাক্ষাৎ। وَأَنَّ إِلَىٰ رَبِّكَ الْمُنتَهَىٰ – “তোমার পালনকর্তার কাছে সবকিছুর সমাপ্তি।” (53:42)
যদি এই ব্যাপারটা ভুলে যান যে, আপনি একটি রেলগাড়ির ভেতরে আছেন বা একটি পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলছেন, বুঝতে পারেন বা না পারেন আপনি আল্লাহর দিকে ছুটে চলছেন। পছন্দ করেন বা না করেন। আপনি কিন্তু নিশ্চলভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় নেই। আপনার সমস্যাটি জীবন থামিয়ে দেয়নি। জীবন এখনো এগিয়ে চলছে। আমার আপনার আল্লাহর সাথে দেখা হবেই।
আপনি যখন বুঝবেন আমি যাই করি না কেন, এই ভ্রমণ থামানোর কোন উপায় নেই। তখন আপনার পক্ষে নিজের গন্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমি যেই এলাকা অতিক্রম করছি, যেই সমস্যাপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করছি, একসময় এটা পার হয়ে যাবে। কারণ এটা আমার গন্তব্য নয়। আমার গন্তব্য হল, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা। এভাবে নিজের মাথায় একটি চিত্র তৈরি করুন।
মনে করুন একটি পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। আর পথিমধ্যে কোন জায়গা থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগলো। যদি চলতে থাকেন গন্ধটা একসময় চলে যাবে। এটা সবসময় আপনার সাথে থাকবে না। চলতে থাকলে একসময় ভালো একটি জায়গায় এসে উপনীত হবেন। আপনাকে হয়তো ভয়ংকর কোন অঞ্চলও অতিক্রম করতে হবে। আপনি চলতে থাকলে এই অঞ্চলও পার হয়ে যাবেন। জীবনও এমনই। আমাদেরকেও এভাবে জীবনের সমস্যাগুলো অতিক্রম করে যেতে হবে। আর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলছেন আপনার আমার জীবনের প্রতিটি ভ্রমণেরই একটি উদ্দেশ্য আছে। আমাদের নিজেদেরকে শুধু একটি প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি পরিশ্রম করছি? দিনশেষে আমরা কী করছি?
৩।
তৃতীয় যে ব্যাপারটি নিয়ে আজ কথা বলবো…আগে আমি বলেছিলাম, মহানবী (স) হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু করতেন নতুবা তাঁর সৃষ্টির উপকারার্থে কিছু করতেন।
আর আমাদের বেলায়, দিনের অধিকাংশ সময় আমরা আত্মসেবায় ব্যয় করি। অবশ্যই আমাদের বিভিন্ন রকম অপরিহার্যতা রয়েছে। আমাদের খাবার আবশ্যক, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রয়োজন, চাকরি-বাকরি করতে হবে – এগুলো সবই আমরা নিজেদের জন্য করি। কিন্তু অবসর সময়ে আমরা কী করি? আয়াতটি কিন্তু আপনার দিনের ২৪ ঘন্টা সময় নিয়ে কথা বলছে না। আয়াতটি আপনার ফ্রী সময় নিয়ে। “ফা ইজা ফারাগতা” “যখন তুমি অবসর পাও…”।
আচ্ছা ঠিকাছে, আপনার এক্ষেত্রে কিছু করার নেই, আপনাকে ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতে হয়, ৬ টার মধ্যে অফিসে উপস্থিত হতে হয় এবং সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিস করতে হয়, সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ট্রাফিক জ্যামে আটকা থাকতে হয়। ঠিকাছে, কোনো সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো উপায় নেই। বুঝলাম, আপনার কোনো অবসর নেই।
কিন্তু যখন অবসর পান তখন কী করে সময় পার করেন? যখন ফ্রী থাকেন সে সময়ে কী করেন? আল্লাহ আপনার জীবনে সহজ সময় আনবেন কি না তা নির্ভর করে অবসর সময়ে আপনি কী করেন তার উপর। অবসর সময়ের কর্মকান্ড তা নির্ধারণ করবে।
তাই নিজের প্রতি সৎ থেকে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, অবসর পেলে আমরা কী করি? আর আমাদের ছেলেমেয়েদের কিভাবে অবসর কাটাতে শেখাই? যখনই তারা একটু ফ্রী সময় পায় ভিডিও গেইম খেলা শুরু করে, যখনই তারা একটু ফ্রী সময় পায় টিভি ছেড়ে দেয়। আমরা উপকারী কিছু করছি না। আমরা প্রোডাক্টিভ কিছু করছি না। একটু সময় পেলেই আমরা স্বার্থপর বিনোদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, স্বার্থপর ভোগ-বিলাসে যুক্ত হয়ে পড়ি।
মাথার মধ্যে শুধু এই চিন্তাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে, দুপুরে কী খাবো? রাতে কী খাবো? কোন সিনেমাটা দেখবো? কিছু দেখতে চাও? কিছু খেলতে চাও? দিন-রাত সারাক্ষণ শুধু বিনোদন, ভোগবিলাস আর অর্থহীন রঙ্গ রসে ডুবে থাকা। আমাদের জীবন এমনই হয়ে গিয়েছে। কিভাবে এটা ‘ফানসাব’? এটা ‘ফানসাব’ নয়। আল্লাহর এই নির্দেশ ”ফা ইজা ফারাগতা ফানসাব (অতএব, যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন।)” কোথায় গেলো?
কোনো ব্যক্তি যদি এভাবে আমোদপ্রমোদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে তখন কি হবে জানেন? এগুলো তার জীবনকে আরো কঠিন করে তুলবে। আমি বলছি না আপনি কোন কিছু খেলতে পারবেন না বা কোনো ধরণের বিনোদন করতে পারবেন না। আমি জানি এটা গ্রীষ্মের সময়। (21 Jun 2019) স্কুল ছুটির কারণে বাচ্চারা এখন খেলাধুলা করতে চায়। এটা ঠিকাছে। কিন্তু তাদেরকে একই সাথে শেখাতে হবে কিভাবে সময়ের উত্তম ব্যবহার করতে হবে। তারা এটা শিখতে পারবে না, যদি তারা আপনার আমার কাছ থেকে না শেখে।
আমরা যদি অবসর সময় পেলেই অপচয় করা শুরু করি, অর্থহীন কাজে নষ্ট করে ফেলি, উপকারী কোন কাজে ব্যয় না করি, তাহলে তারাও এই অভ্যাস আমাদের কাছ থেকে আয়ত্ত করবে তাদের মত করে। আমরা দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছি। আমরা আমাদের আচার আচরণকে তাদের জন্য অনুকরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করছি।
আমরা এই আয়াত অনুযায়ী জীবন যাপন করলে, তারা প্রশ্ন করবে “কেন তুমি সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকো? কেন আমরা সবসময় কাউকে না কাউকে সাহায্য করি? আমরা এতবার মসজিদে যাই কেন? আমরা সারাক্ষণ এটা ওটা শিখছি কেন? আমাদের অবসর কোথায়?” তখন আপনি তাদের মনে করিয়ে দিবেন – فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ – অর্থঃ “অতএব, যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন।” আমরা কেন এটা করবো? কারণ আমরা চাই আল্লাহ যেন আমাদের জীবনকে সহজ করে দেন। আল্লাহ বলেছেন – فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا – إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا – “নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।” فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ – “অতএব, যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন।” وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَارْغَب – “এবং আপনার পালনকর্তার প্রতি মনোনিবেশ করুন।”
এই নির্দেশগুলো আমাদের মহানবী (স) কে প্রদান করা হয়েছিল। এই বিষয়গুলোর উপর ফোকাস করতে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমরা যদি আমাদের জীবনকে উন্নত করতে চাই, আমাদেরকেও এই পাঠগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি আমাদের জীবনে সহজ সময়ের স্পর্শ পেতে চাই।
আমাদের সবারই জীবনে কোন না কোন সমস্যা রয়েছে। এখানে এমন কেউ নেই যিনি সমস্যা ছাড়া আছেন। জানেন? একটি সমস্যার সবচেয়ে কঠিন দিক কোনটি? সমস্যাটির বাহ্যিক দিক মোকাবেলা করা সবচেয়ে কঠিন নয়। সর্বাপেক্ষা কষ্টকর ব্যাপারটি ঘটে আমাদের হৃদয়ে। সর্বাপেক্ষা দুরূহ ব্যাপার হল সমস্যার সময় আমার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা। সবচেয়ে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হল আমার চিন্তাগুলো। এটা আমাদের পুরোপুরি অসাড় নিস্তেজ বানিয়ে দেয়।
এখন সূরাটি দিকে লক্ষ্য করুন, প্রথম যে স্বস্তি আল্লাহ আমাদের রাসূল (স) কে প্রদান করেছেন: ” আলাম নাশারাহ লাকা সদ্রাক – (হে নবী! ওয়াহীর মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান ও মানসিক শক্তি দিয়ে) আমি কি তোমার বক্ষদেশকে প্রসারিত করে দেইনি?”
আমি তোমাকে প্রশান্তি দান করেছি। এখন মানুষ যখন শুনতে পায়, আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা মহানবী (স) কে মানসিক প্রশান্তি দান করেছেন। একজন মানুষের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে যাতনাদায়ক সময়েও তিনি মানসিক দিক থেকে প্রশান্তিতে ছিলেন। কেন তিনি প্রশান্তিতে ছিলেন? আল্লাহ এর রহস্য সূরার শেষের দিকে বর্ণনা করেছেনঃ فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ – অতএব, যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন। – وَإِلَىٰ رَبِّكَ فَارْغَب – এবং আপনার পালনকর্তার প্রতি মনোনিবেশ করুন।
আমরা যদি এই কাজটি করতে পারি, তাহলে আশে পাশের মানুষ আমাদের সম্পর্কে যাই বলুক না কেন এতে কিছু যায় আসে না, বাহ্যিক দিক থেকে আমরা যে সংকটেই থাকি না কেন তাতেও কিছু যায় আসে না, আমরা মানসিক দিক থেকে দারুণ প্রশান্তিতে থাকবো। আমাদের অন্তর শান্ত থাকবে, আমরা স্থির থাকতে পারবো। অন্য সবাই হয়তো কাঁদবে, নার্ভাস থাকবে, উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ব্যাকুল হয়ে পড়বে এবং সব ধরণের মানসিক অশান্তির মাঝে থাকবে, কিন্তু আপনি নিজেকে প্রশান্ত পাবেন, মানসিক দিক থেকে ধীর স্থির থাকবেন।
কারণ আপনি এই মহাসত্য অনুযায়ী পথ চলছেন।
আমি দোয়া করি, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা যেন আমাদের সবার অন্তরে শান্তি দান করেন, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদেরকে ঐ সমস্ত মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করুন আল্লাহর করুণায় যাদের হৃদয় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং বক্ষ সম্প্রসারিত হয়ে যায়। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের দৃঢ় মনোবল ওয়ালা মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করুন যেন আমরা আমাদের সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি এবং এর ফলে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের জীবনে কষ্টের চেয়েও বহুগুণ বড় স্বস্তি নিয়ে আসেন।