সুর ও আল-কুর’আনের মু’জিযা

সুর ও আল-কুর’আনের মু’জিযা

 

যারা আরবী জানেন ও যারা জানেন না – তারা এই শব্দগুলোকে একটু মনযোগ দিয়ে উচ্চারণ করুন আর দেখুন কোনো মিল খুঁজে পান কি না:

যাকারিইইয়া, খাফিইইয়া, শাকিইইয়াহ, রাজিইইয়াহ, ওয়ালিইইয়া, শারিইইয়া, নাবিইইয়া, হাইইয়া ইত্যাদি।

যারা আরবী জানেন না তারা কি কিছু লক্ষ্য করেছেন?

যারা আরবী জানেন না তারা নিশ্চয় শব্দগুলো কীভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তা লক্ষ্য করেছেন। সবগুলো একই সুরে অন্তমিলের সুর ছড়াচ্ছে। এটি সূরা মারিয়ামে রয়েছে, যা পবিত্র কুর’আনের অন্যান্য সূরার মতোই একটি সূরা। প্রত্যেকটি আয়াতের সমাপান্তে শব্দগুলোতে অন্তমিলের সুরবিন্যাস রয়েছে।

যিকরু রাহমাতি রাব্বিকা আব্দাহু যাকারিইইয়াহ, ইজ নাদা রাব্বাহু নিদাআন খাফিইইয়া (২-৩) ইত্যাদি।

আর এভাবে এটা সমাপান্তে সুর করে চলতেই থাকছে…চলতেই থাকছে…।

কিন্তু, কিছুদূর যাওয়ার পর কী দেখতে পেলেন? সূর পাল্টে গেছে (ইয়ামতারুন)?!!

কিন্তু কেন?

এটা আর আগের শব্দগুলো খাফিইইয়হ, শাকিইইয়া বা ইনশিইইয়া এগুলোর মতো সুর মিলছে না শব্দান্তে।

এখন শুরু হয়েছে শব্দান্তের মিলের ভিন্ন সুরধ্বনি:

ইয়ামতারুন, ফা ইয়াকুন, মুস্তাকুন, আযিম, মুবিন, ইউমিনুন।

সুতরাং, এভাবে আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রাথমিক কিছু আয়াত যেগুলো একই সুরের অন্তমিলের সুরধ্বনি, আর কিছুদূর যাওয়ার পর একই সূরায় অন্তমিলের ভিন্ন সুরধ্বনি। অথচ একই সূরায়, কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে ভিন্ন সুর।

যখন বিষয়টি ছিল একই, নবীদের কাহিনী, তখন সূরের অন্তমিলের ধ্বনিও ছিল একই-অভিন্ন। কিন্তু যখনই বিষয়টি (Topic of Subject) পরিবর্তিত হয়েছে তখনই ভিন্ন অন্তমিলের সুরধ্বনি এসেছে। এটা এক প্রকার প্যারাগ্রাফ-এর মতো যেখানে প্রতি প্যারায় একই টপিকের ভিন্ন ভিন্ন দিকের আলোচনার মতো। আপনি স্পেস দেন লেখায়, ট্যাব চাপেন বেশি দূরে যাওয়ার জন্য, সরিয়ে নেন, একটার উপর আরেকটা লেখেন, বা অনেকটটা জায়গা ছেড়েও দেন লেখার বিভিন্ন ধরণের জন্য। কিন্তু কুর’আনে এগুলো নেই! তাহলে কুর’আনে কী আছে? এটার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুরবিন্যাস। যেহেতু একটি বিষয় পরিবর্তিত হয়েছে, আর সেজন্য শ্রোতা যাতে বুঝতে পারে যে এখন নতুন বিষয় এসেছে, তাই এভাবেই কুর’আনের সুরবিন্যাস হিসেবে এসেছে।

কিন্তু আরো চমৎকার বিষয় এখানে কি জানেন? আপনি যখন আবার পূর্বের বিষয়ে ফিরে যাচ্ছেন (একই Topic of Subject), তখন আয়াতের অনেক পরে যাওয়ার পরেও সেখানে দেখবেন পূর্বের বিষয়টির যে সুরবিন্যাস ছিল সেই একই সুরবিন্যাস এসেছে, অথচ মাঝে অনেক আয়াত কিন্তু অন্যরকম ছিল, ভিন্ন সুরবিন্যাসের ছিল!!!

ওয়াযকুরু ফিল-কিতাবি ইব্রাহিম, ইন্নাহু কানা সিদ্দুকান নাবিইইয়া(৪১)…

নবীদের কাহিনী ফিরে এসেছে, সেই সাথে সেই পূর্বেকার সুরবিন্যাসও ফিরে এসেছে!!

এই কুর’আন কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়। এটা অনেক সিরিয়াস বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। কিন্তু এরপরও শ্রবণকারীদের জন্য এটাকে এমনভাবে আল্লাহ বিন্যাস করে দিয়েছেন যে আপনি একটা বিষয় জানেন এর সুর বিন্যাসের অভিন্নতা দিয়ে, একই সুরের অন্তমিলের একই গাঁথুনি দিয়ে। যখনই কোনো বিষয় পরিবর্তিতি হয়ে যায়, তখনই এটা অগ্রসর হয় কোনো ভিন্ন বিষয় নিয়ে। আবার যখন একই সুরের বিন্যাসে ফিরে আসে, তখন এটা পূর্বের একই বিষয়ে ফিরে আসে। এই মোড় পরিবর্তন প্রয়োজনীয় এ কারণে যেন পূর্বের বিষয়টাকে সম্পন্ন করা যায়। সুবহানাল্লাহ!! এরকম বিষয় কি [মানুষের রচিত] কোনো টেক্সটে সম্ভব?!!

যারা সূরা আন-নাবা জানেন তারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন:

আম্মা ইয়াতাসাআলুন,
আনিন নাবাইল আজিম,
আল্লাজি হুম ফিহি মুখতালিফুন,
কাল্লা সাইয়া’আলামুন,
ছুম্মা কাল্লাসাইয়া’আলামুন(১-৫)।

—এটা একটা প্যারাগ্রাফ।

আলাম নাজয়ালিল আরদা মিহাদা,
ওয়াল জিবালা আওতাদা,
ওয়াখালাকনাকুম আজওয়াযা,
ওয়াজাআলনাকুম সুবাতা…

— দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ

যখন একটা বিষয় শেষ, অন্য বিষয়ের ভিন্ন সুরবিন্যাস এসেছে…সুবহানাল্লাহ!!!

কখনও কখনও আপনি অনেক লম্বা প্যাসেজ দেখবেন একই সুরের বিন্যাস গাঁথুনি দিয়ে চলেছে, আর মাঝখানে এ সুরের বিন্যাস ছুটে গেছে, পূর্বের সূরবিন্যাসের সাথে যাচ্ছে না …কারণ কী? এই মোড় ঘোরানোটা অন্য পর্বের পূর্বের অংশের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল (যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে ও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে)। পড়ার সময় আপনাকে অবশ্য মনোযোগ দিতে হবে এটা ধরতে।

আল্লাহ বলেন—-

লা উকসিমু বিইয়াওমুল কিয়ামাহ,
ওয়ালা ওকসিমু বিননাফসিল্লাওয়ামাহ,
আ ইয়াহসাবুন্নাসু আল্লান নাজমাআ ইজামাহ,
বালা ক্বাদিরিনা আলা আন নুসাওভিয়া বানানাহ,
বাল ইউরিদুল ইনসানু লিইয়াফিজুরা আমামাহ,
ইয়াসআলু আইইয়ানা ইয়াওমুল কিয়ামাহ। (সুরা কিয়ামাহ, ১-৬)

…এখানে এসে বিষয়ের সমাপ্তি ঘটেছে।

এরপর শুরু হয়েছে নতুন বিষয় এভাবে…

ফা ইযা বারিকাল বাছার,
ওয়াকাসাফাল কামার,
ওয়াজুমিয়াশ শামসুল ওয়াল কামার,
ইয়াকুলুল ইনসানু ইয়াওমা ইজিন বিমা কাদ্দামা ও আখখার,

…এখানে বিষয় শেষ…এরপরে কী হচ্ছে?

পরবর্তী বিষয় এসেছে…

বাল ইনসানু আলা নাফসিহি বাসিরাহ,
ওয়ালাও আলকা মাআজিরাহ,

সেই পূর্বের সুরবিন্যাস শুনতে পাচ্ছেন? … এরপর বিরতি এসেছে … কারণ পরবর্তী বিষয় উপলব্ধির জন্য আপনাকে দেখতে হবে … লা তুহাররিকু বিহি লিসানাকা লিতাআজালা বিহ … এবং আবার ফিরে যান পশ্চাতে … সুবহানাল্লাহ!!!

এখন পর্যন্ত কোনো বইয়ে এরকম পেয়েছেন?

আরবীতে নেই একরম কোনো বিষয়।
মুহাম্মাদ ছিলেন না কোনো কবি,
তাঁর জন্য কুর’আনের আয়াতেই বলে দেওয়া হয়েছে কবিতা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়,
তিনি ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন,
এটা ছিল কবি নন এমন মানুষের মুখ দিয়ে অসাধারণ মু’জিযা – কবিত্বকে হার মানিয়ে দেওয়া কিতাব,
এটা ছিল বক্তৃতা আকারে নাযিলকৃত, যা একবার বললে ফেরত নেওয়া অসম্ভব, অথচ একই সূরায় এরকম অনেকবার এসেছে যে সূরা কয়েক বছরেও নাযিল হয়েছে … এরকম কি কোনো নিরক্ষর, কবি নন, এমন মানুষের পক্ষে কয়েক বছর পরেও স্মরণ রাখা সম্ভব? … অসম্ভব। এটা আল্লাহর দেওয়া সেই কিতাব যার শুরুতে সমস্ত কিতাবের ঠিক উল্টো কথা বলে দেওয়া আছে … এতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই, পারলে এর মতো একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে এসো … চ্যালেঞ্জ।

অথচ, এটা ছিল সমগ্র বিশ্ববাসীর মাঝে, গর্বিত সাহিত্যিকদের সম্মুখে, একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ দিয়ে রবের দেওয়া বাণীর চ্যালেঞ্জের বাণী … এটা ছিল একাধারে বক্তব্য আকারে নাযিলকৃত, যা একবার বললে আর ফেরত নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর এমন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখে উচ্চারিত বাণীই ছিল সমগ্র বিশ্বের রবের পবিত্র কুর’আনের নাযিলকৃত সৌন্দর্য, পবিত্রতা, জীবনবিধান এবং চ্যালেঞ্জ।

মূল সোর্স থেকে কিছুটা সংযোজন করে লেখা—উস্তাদের Quran and science লেকচার থেকে অনুপ্রাণিত