আমরা কেন কোরআনে বিশ্বাস করি
আরবরা ছিল ট্রেডিশনাল মানুষ, তারা যাযাবরদের মত ভ্রমন করত। যেহেতু তাদের ভূমি ছিল অনুর্বর এবং মরুভূমি আর সেকারণে ভূ-রাজনৈকিত ও অর্থনৈতিকভাবে কেউ তাদের উপর আক্রমন করত না-কারণে সেখানে কোন লাভ নেই।
আরব ছিল রুমান ও ইরানিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যভাগে আর সেকারণে কেউ তাদের সাথে কোন সমস্যা তৈরি করত না এই ভয়ে যে এতে এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে ভয়াভহ যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। তারা অন্যান্য সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো, কারণ সেখানে সম্পদ ছিল আর এসব আরবে অনুপস্থিত ছিল অনুর্বর, মরুভূমি ও উন্নত সম্পদ না থাকায়। এভাবে আরবদেরকে ততকালীন উন্নত সাম্রাজ্য শত শত বছর বিচ্ছিন্ন রেখেছিল তাদের প্রভাব থেকে। আর এইসব বিচ্ছন্নতার কারণে আরবরা ছিল তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাহিরের কোন প্রভাবও ছিল না। আর কেউ যখন বিচ্ছিন্ন থাকে তখন কিন্তু নিজের সাথেই কথা বলে। আর এভাবেই তাদের ভাষায় অন্যদের প্রভাব না থাকার কারণে বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতম হতে থাকে এবং বিশুদ্ধই থাকে। আর অন্যরাও এ ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী ছিল না কারণ এতে পার্থিব-সম্পদগত কোন লাভ নেই!
আপনারা জেনে থাকবেন যে যখন অনেকগুলো কালচার বা শক্তিশালী ক্ষমতা অন্যকে দখল করে নেয় তখন সেই স্বদেশীয় ভাষা কলুষিত হয়(যেমন বাংলা—কত ভাষার সমষ্টি ও বিকৃতি এসেছে এ ভাষায়-সেই ওলন্দাজ থেকে ইংরেজ সাম্রাজ্য পর্যন্ত) অথবা যে কোন দেশ বা অঞ্চল বৈশ্বিক বাজারে বা কসমোপলিটানে রুপান্তরিত হয় সেখানেও ভাষার ভিন্নতা দেখা যায় যেমন প্রাচীনকালের চিটাগাং(সামুদ্রিক ব্যবসায়ী কেন্দ্র ছিল) বা নিউইয়র্কে বিভিন্ন দেশের লোকেদের ইংরেজির বেহাল অবস্থা! এভাবে একটি ভাষা যখন কোন প্রভাব ব্যতিত টিকে থাকে, সেটা বিশুদ্ধ থাকে-সেরকম ছিল আরবী ভাষা। আরবের চতুর্পার্শে কিছুই ছিল না, কেবল মরুভূমি ছাড়া। আর এজন্য তাদের কাল্পনিক চিন্তাশিলতা ছিল প্রখর(যেহেতে চতুর্পাশ্বে কিছু ছিল না তাই কল্পনার চিন্তাশক্তিই তাদের শৈল্পিক দিক ছিল)। যখন কারো চতুর্পাশ্বে কিছুই থাকে না, তখন মগজই একমাত্র চিন্তার খোরাক হিসেবে থাকে আর আরবরটা এরকমই মরুভূমির মধ্যে প্রিজনার বা বন্ধির মত ছিল আর সেকারণে তাদের চিন্তার প্রখরতাও উন্নত ছিল। পৃথিবীর অনেক উল্লেখযোগ্য লেখাই জেলখানার ভেতরে হয়েছে। কারণ এখানে চিন্তাশিলতার সময় ও সুযোগ দুটোই থাকে—তেমনি ছিল আরবদের চিন্তাশিলতার প্রখরতা।
পৃথিবীর সকল দেশের গর্বের কিছু বিষয় থাকে। যেহেতু আরবদের গর্ব করার মত অন্য কোন জিনিস ছিল না আর সেজন্য ভাষাই ছিল তাদের উচ্চমার্গের গর্বের বিষয়। তাদের ভাষার তুলনায় অন্য ভাষাকে তুচ্ছ মনে হত-এরকম উচ্চ, শক্তিশালী, এবং চিন্তাশীল গ্রাফিক ভিজুয়াল ছিল তাদের ভাষায়। আর কেউ যখন কোন কিছুর প্রতি গর্ব করে তারা সেটার পরিচর্যা করে আর আরবরাও ভাষার ভালো পরিচর্যা করত। তারা কবিদের মন্ত্রীর মর্যাদা দিত। গোত্রেরা কবিতার প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ করত। তারা এতটাই ক্রুদ্ধ থাকত যে অন্য গোত্রের কবিদের পরাজিত করতে না পারলে নিজেদের কবিকে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলত- এরকম গর্বের ছিল তাদের ভাষা।
যখন কোরআন তাদের কাছে আসল এটা তাদেরকে কোরআনের মত কিছু তৈরি করতে চ্যালেঞ্জ করল। যখন আরবরা জানত না যে এটা কোরআন এবং রাসূল সা এটাকে কোরআনের আয়াত না বলে এটা চ্যালেঞ্জে আকারে দিল। আরবের সবাই হেরে গিয়ে তারা এর আয়াতকে কাবা শরিফের ঝুলিয়ে রেখেছিল এবং বলেছিল এটা মানব সৃষ্ট হতে পারে না।(সর্বাপেক্ষা সেরা সাহিত্যগুলোকে তারা সম্মানার্থে কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত)। পরে অবশ্য এটা কোরআনের আয়াত জানার পর তারা সরিয়ে নিয়েছিল !!
আরেকটি ঘটনা ছিল এরকম যে ওয়ালিদ বিন মুগিরা ছিল আরবের সর্বশ্রেষ্ট কবি। তিনি খুবই কনফিডেন্ট ছিলেন। সে রাসূল (সা) কে নারী, সম্পদ এবং শাসকের লোভ দেখায় যাতে এগুলো থামিয়ে দেয়। রাসুল (সা) কোরআন পাঠ করতে লাগলেন এবং এটা শুনে মুগিরা প্রচন্ডভাবে কাঁদতে লাগল। আর রাসূল (সা) এর মুখ চেপে ধরে বলল আমি আর নিতে পারছি না এটা!! সে তার দলের লোকের নিকট ফেরত এসে বলল – আমি কবিতা জানি, কিন্তু এটা কবিতা নয়। আমি যাদু চিনি কিন্তু এটা যাদু নয়। আমি পাগলামো বুঝি কিন্তু এটা পাগলামো কোন কথা নয়।
এমনকি রাসূল সা এর একজন কবি ছিল হাসসান(রা)। সে একটা কবিতা রচনা করেছিল তার গোত্র নিয়ে, সে আরবের সর্বশ্রেষ্ট কবি ছিল । কিন্তু একজন মহিলা কবি, একজন মহিলা!! সে হাসসানের সেই কবিতাকে আরবী সাহিত্যিক সমালোচনা দিয়ে একেবারে পচিয়ে দিয়েছিল!! একজন মহিলা এভাবে পচিয়েছিল আরেকজন কবিকে!! তারা সমালোচনা করতে ভালোবাসত, এটা তাদের রক্তের সাথে মিশে ছিল, এভাবে অন্যকে তারা শুদ্রে দিত এবং নিজেদের মর্যাদা নিত।
কিন্তু কোরআন আসার পর কি হল???
কোরআন তো তাদের চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল এর অনুরুপ কিছু নিয়ে আসতে…সেটা না করে তারা মুসলিমদেরকে মারতে আসল কেন?!!! অথচ তারা কোরআনের ভুলগুলোকে শুদ্রে দিতে পারত খুবই সহজে, বাকপটুতা এবং সাহিত্যিক দিক থেকে তারা তো শ্রেষ্টই ছিল!! তাদের ভাষা তো ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ভাষা। তারা তো কিছু বাক্য নিয়ে আসলেই পারত, কারণ কোরআন তো কিছু শব্দের সমষ্টিই…মাত্র ৪০০ পেইজের বই ছিল এটি…কিন্তু তারা তিন আয়াতের মত কিছু নিয়ে এসে কোরআনের চ্যালেঞ্জকে ছুড়ে ফেলে দিত…তাহলেই তো ইসলামের চ্যালেঞ্জ শেষ, ইসলামের খেল সেই অংকুরেই মাঠে মারা যেত…কিন্তু তারা একেবারে হতবুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।!! তবুও আল্লাহ বলেছিল তোমরা তোমাদের সবাইকে নিয়ে এসে পারলে এর মত কিছু বানাও!!. এটাই ছিল মুসলিমদের কোরআনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তি। কোরআন কোন অন্ধ বিশ্বাস নয়, এতে রয়েছে যুক্তি, বিজ্ঞান, রয়েছে দৃঢ় বিশ্বাসের শক্ত ভিত্তি।
একটি মু’জিযা এবং বর্তমান জিওগ্রাফি
আল্লাহ রোমান এবং পার্সিয়ানদের(তৎকালীন ইরানিয়ান সভ্যতা)কথা বলেছে। রোমানরা পরাজিত হয়েছিল আর পার্সিয়ানরা বিজয়ী হয়েছিল। আর এটা হয়েছিল ফিলিস্তিন-ইজরাইলীয় উপকূলীয় এলাকাসমূহের দিকে, Dead Sea এলাকায়। আর কোরআনে এখানে বলেছে “রুমানরা পরাজিত হয়েছিল সর্ব নিম্নাঞ্চলে”(সূরা রুম -৩)। আশ্চর্যের বিষয় হল কোরআন কিন্তু বলেনি ‘নিম্নাঞ্চল’(Low Earth) বা ‘তুলনামূলক নিম্নাঞ্চল’(Lower Earth) যেরুপ উপত্যকায় দেখা যায়। বরং বলেছে Lowest of the Entire Earth পৃথিবীর সর্বনিন্মাঞ্চল। আর জিওগ্রাফি অনুযায়ী ডেড সি বা মৃত সাগরের অঞ্চল হল পৃথিবীর সর্বনিম্নাঞ্চল এলাকা !! পানির নিচে সর্বনিম্ন এলাকা অন্যটি কিন্তু জমিন বা অঞ্চলগত দিক থেকে মৃতসাগর এলাকাই পৃথিবীর সর্বনিম্নাঞ্চল। আর কোরআন ঠিক এটাই বলেছে সেই কত শত বছর আগে যখন এটা আবিষ্কৃত হয়নি জিওগ্রাফিক্যালি !!
অথচ যখন এই বিষয়টি নাযিল হয়েছিল কোন লোকজন জিজ্ঞেসো করেনি এটি কোথায়?!
এভাবেই কোরআনের অসংখ্য চ্যালেঞ্জ দেখিয়েছে যে এটি কোন মানবরচিত গ্রন্থ নয়, এর বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ(যা ২য় পর্বে দেখিয়েছি) কেউ মোকাবিলা করার সাহস পায় নি। এভাবেই যুগে যুগে কোরআন টিকে আছে তাঁর ঐশি মর্যাদা নিয়ে, বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ, পার্থিব জীবনের পবিত্রতা, সুখ এবং পরকালীন জীবনের নিশ্চিত প্রশান্তি ও নিরাপত্তার পয়গাম নিয়ে।
নেয়া হয়েছে “Quran For Young Adults, Day 11, Session 2 (Bayyinah.tv) থেকে।
——– অন্য দুই পর্বের লিংক———
কোরআন কেন মানুষের সৃষ্টি হতে পারে না – ২য় পর্ব (কোরআনের চ্যালেঞ্জ বলতে কী বুঝায়?)