ইসলাম ও ইগো (আত্ম-অহংকার)

{{unknown}}

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি এবং কিছুটা আশ্চর্যও হয়েছি আপনারা এতক্ষণ অপেক্ষা করেছেন দেখে আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমার কণ্ঠস্বর কিছুটা ক্লান্ত মনে হতে পারে কারণ আমি আসলেই তাই … আট ঘন্টার টানা লেকচার ছিল কিন্তু আমি ইনশাল্লাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত কিছু কথা শেয়ার করব। এটা এমন একটা বিষয় যা এখন আর তেমন আলোচনায় আসে না কিন্তু এর প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কোন সন্দেহ নেই যে এই বিষয়ের প্রতি আমাদের নজর দেয়া দরকার ইনশাল্লাহ।

আমি আপনাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি মুসলিম তরুণদের নিয়ে যারা কোন ধর্মীয় পথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজে। তাদের মাঝে এক সংষ্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেক সময়ই মুসলিম তরুণরা যে জীবন যাপন করে তাকে বলা যেতে পারে … মনে করুন ‘পার্টিইং’ … ঠিক আছে … এবং তারপর জীবনের কোন এক সময় তারা কোন বিশেষ উপলব্ধির মুখোমুখি হয় এবং দ্বীনের পথে চলতে শুরু করে। এমন প্রচুর ভাই-বোন আছে যারা জীবনের কোন এক সময় পরিবর্তিত মানসিকতার ভেতর দিয়ে যায় এবং তারপর ধীরে ধীরে আরও ধার্মিক হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপর যা হয় তা হচ্ছে, যখন সময়ের সাথে সাথে তারা আরও ধার্মিক হয়ে ওঠে, তারা অনেক বেশি কড়া হয়ে যায় এবং নিজেদের জন্য নিজেরাই কোন শিক্ষক খুঁজে নেয়।

সেই শিক্ষক হচ্ছে কখনো কোন মানুষ, কখনো কোন লেকচার সিরিজ, কখনো কোন ওয়েবসাইট, কখনো ব্লগ, কখনো অপরিচিত কোন নাম কিন্তু সেটা যাই হোক না কেন, তারা নিজেদের জন্য একটা জ্ঞানের উৎস খুঁজে নেয় যেটাকে তারা “সঠিক” বলে মনে করে। এর প্রতি তারা খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে যা ঘটতে শুরু করে তা হচ্ছে তারা খুব কঠোর ও অনমনীয় হয়ে ওঠে। তারা লক্ষ্য করতে শুরু করে যে তাদের চারপাশের মানুষরা ঠিক তাদের মতো না। তারা যাকে শিক্ষক মানে তাদের চারপাশের মানুষরা তাকে শিক্ষক মানে না। তারা যেভাবে দ্বীনকে বোঝে অন্যরা সেভাবে বোঝে না। তাই প্রথমে যা হয় তা হচ্ছে তারা তাদের চারপাশের বিশেষ করে তাদের পরিবারের মানুষদের ব্যপারে হতাশ হতে শুরু করে। মুসলিম তরুণ বা তরুণীটি ভালোর দিকে পরিবর্তন হতে শুরু করে এবং সবার আগে তারা যাদের ওপর হতাশ হয়ে ওঠে তারা হচ্ছে তাদের নিজেদের পরিবার। “কেন তোমরা বোঝ না?” “এটাই দ্বীন পালনের সঠিক পথ!” এবং এমন আরও অনেক অনেক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

এমন ঘটনা ‘মুসলিম’ পরিবারের মাঝেই ঘটে। আপনি যদি মুসলিম হন এবং আপনার পরিবার যদি অমুসলিম হয় তাহলে এর মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু মুসলিম পরিবারের মাঝে থেকেও যদি আপনি দ্বীনকে নতুন করে আবিষ্কার করেন তাহলেও এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই রকম সমস্যা শুধু পরিবারের মাঝেই যে সীমাবদ্ধ থাকে তা না বরং বন্ধুমহলেও এর বিস্তার ঘটে। অনেক সময় এমন হয় যে কেউ হয়ত আপনার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল কিন্তু সে হয়ত কোন ধর্মীয় পথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে না বা হয়ত সে যাচ্ছে কিন্তু সেই পথটা হয়ত আপনার মতো না। তাদের দ্বীনের বুঝ হয়ত কিছুটা অন্যরকম অথবা কিছু বিষয়ে হয়ত তারা আপনার মতো এতটা কড়া না। হয়ত কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে তারা আপনার মতো এতটা কঠোর না এবং এটা মেনে নেয়া আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আপনি তখন তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলেন। যখন আপনি এমন মানুষদের সংস্পর্শে আসেন যারা দ্বীনকে আপনার মতো করে দেখে না তখন এটাকে কেন্দ্র করে আপনি তাদের বুঝিয়ে দেন যে তারা ভুল আর আপনিই ঠিক; এভাবেই তাদের দ্বীন পালন করা উচিত এবং এছাড়া অন্য আর কোন পথ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন এক ধরণের আচরণ গড়ে ওঠে, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে।

এমন আচরণের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তরুণ বা তরুণীটি নিজে মনে করে যে সে যা করছে তা হচ্ছে আমর বিন মা’রুফ ওয়া নাহিয়ান আল মুনকার। তারা মনে করে যে তারা ভালো কাজে আদেশ দিচ্ছে ও মন্দ কাজে নিষেধ করছে। তারা তো তাদের ভাই/বোনদের কোন হাদিস বা কোরআনের আয়াতই বলছে। ভালো কাজই তো করছে তারা! এটাই তো তাদের করা উচিত … এমন কথাই তাদের মাথায় থাকে। তারা যা বুঝতে পারে না তা হচ্ছে, এখানে আরও একটা ব্যপার ঘটছে। দ্বীনের পথে আসার আগে আপনি হয়ত বন্ধুমহলে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন। যখন আপনি ধর্মের পথে আসলেন তখন আপনাকে ঘিরে আর সেটা রইল না কিন্তু আপনার এখনো তেমন একটা কিছু চাই। অন্যদের ওপর নিজের আধিপত্য দেখানোর জন্য আপনার ভেতর এক ধরণের জিদ কাজ করে। আপনার মনে হয় যে, আমি মানুষকে দেখাতে চাই কোন না কোন ভাবে আমি তাদের চেয়ে সেরা এবং এই ঘুরপথে চলতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় নিজের অজান্তেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে তারা নিজেদের ধর্মীয় মতামত জানাতে থাকে। তারা মানুষের কাছে প্রমাণ করে দিতে চায় যে অন্যরা আসলে ধর্মটা ঠিকমত জানে না।

“আমি ধর্ম সম্পর্কে ঠিকমত জানি, আসো তোমাকে বলি কোনটা সঠিক। আসো তোমাকে এই আয়াতটা শিখাই। এই হাদিসটা বলি। তুমি জান না যে এটা এভাবে না ওভাবে?”

মানে ধর্ম নিজেই আপনার ইগো প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক কারণ ধর্ম নাযিল হয়েছিল যেন আমরা নিজেদের বিনয়ী করে তুলি। কিন্তু এখন আমরা সেই একই ধর্ম ব্যবহার করছি নিজেদের অহংকার প্রকাশ করতে। তবে এমনটা যে শুধু আমাদের তরুণদের মাঝেই ঘটে তা কিন্তু না, বড়দের মাঝেও এমন হয়। আপনারা ইবলিসের কথা জানেন? সে কিসে আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল? সে সিজদাহ করতে রাজি হয়নি। আদম(আঃ)-কে আল্লাহ কী কাজ দিতে যাচ্ছিলেন? কেমন উচ্চ বেতন তিনি পেতে যাচ্ছিলেন? আদম(আঃ) কী পদোন্নতি পেতে যাচ্ছিলেন যেটা দেখে ইবলিস বলে উঠেছিল, না! না! না! আমি এই কাজের জন্য বেশি উপযুক্ত … কী ছিল সেই কাজ? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কী উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন? ইবাদতের উদ্দেশ্যে! ঠিক? এবং আদম(আঃ)-কে বলা হয়েছিলঃ ইন্নী জায়ীলুন ফিল আরদি খালীফাহ।

আল্লাহ উনাকে কোথায় ন্যস্ত করতে যাচ্ছিলেন? পৃথিবীতে। এবং কী ছিল উনার দায়িত্ব? আল্লাহর কাজ করা। এটা একটা ধর্মীয় উপাধি। আরও সহজভাবে যদি বলি, আদম(আঃ)-কে ধর্মীয় সম্মান দেয়া হয়েছিল, দুনিয়াবি সম্মান না। উনাকে কোন উচ্চ বেতন বা বিশাল বাড়ি দেয়া হয়নি। উনাকে ধর্মীয় মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। তাই আপনি যদি এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেন তাহলে কিছুটা অবাক হবেন। ইবলিস এক ধর্মীয় মর্যাদার কারণে আদম(আঃ)-কে হিংসা করছিল। তার ইগো প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল কারণ সে মনে করছিল আল্লাহর দ্বীনের কাজ করার জন্য আদম(আঃ)-এর চেয়ে সে বেশি যোগ্য।

“দ্বীনের কাজ করার জন্য আমি বেশি যোগ্য।”

এই অহংকার প্রকাশ পেয়ে যায় যখন কেউ দাবী করে যে মসজিদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সে বেশি উপযুক্ত।

“প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমিই বেশি উপযুক্ত, তাকে কেন বেছে নেয়া হলো?” “তাকে কেন এই কাজের দেয়া হলো?” “আমাকে কেন নেয়া হলো না?”

এটা একটা ধর্মীয় কাজ। প্রেসিডেন্ট হলে আপনাকে টাকা দেয়া হবে না। মসজিদ পরিচালনার জন্য আপনাকে নতুন গাড়ি দেয়া হবে না কিন্তু তারপরও আমেরিকাজুড়ে আমরা দেখতে পাই কিসের জন্য মানুষ জান দিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে? ধর্মীয় খেতাবের জন্য! মসজিদ পরিচালনায় কে থাকবে?? কার কথা শোনা হবে??

কিন্তু কেন??

এই রোগের সূচনা কোথায় হয়েছিল? সেই কাহিনী যথেষ্ট পুরান। এই রোগের ভাইরাস ইবলিসের থেকে শুরু হয়েছিল। সেও এই ধর্মীয় কর্তৃত্ব চেয়েছিল। মূল বিষয় হচ্ছে, এটা এক প্রকার অসুখ এবং এটা যদি কারও মাঝে থাকে তাহলে তার সেটা অতিসত্বর চিহ্নিত করা উচিত। যখন আপনার মনে হয়, “ভাগ্যিস আমি ছিলাম। আমি না থাকলে এই মানুষরা একদম বিপথে চলে যেত। এদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য অন্তত আমি আছি!”, তখন আমি বুঝবেন যে এই মনোভাব আপনার ভেতরে প্রবেশ করেছে।
যদি এইরকম হয় আপনার মনোভাব তাহলে আপনি ভীষণ সমস্যার মাঝে আছেন। সত্যিই আপনি ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছেন কারণ আপনি ভাবছেন এই দ্বীন কার ওপর নির্ভর করে? আপনার ওপর … দ্বীনের আমাদেরকে প্রয়োজন নেই; আল্লাহর দ্বীনকে আমাদের প্রয়োজন কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের আমাদেরকে প্রয়োজন নেই।

“ওয়াল্লাহু গানিয়ুন হামীদ”। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সমস্ত প্রয়োজন থেকে মুক্ত।

তাঁর আমাদেরকে প্রয়োজন নেই। আমাদের নিজেদেরকে আরও বিনয়ী করে তুলতে হবে। আমি এতক্ষণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইগোর কথা বললাম কিন্তু পরিবারের মাঝেও দেখা যায় যে আমরা বলছি, “আমি মারা গেলে কে এই পরিবারের দেখাশোনা করবে? কে বিল পরিশোধ করবে? আমি না করলে কে এইসব করবে?”

এমন ভাবনা আপনার মনে আসে, ঠিক? কিন্তু আপনি যতই ভাবুন না কেন যে আমার এত টাকা জমাতে হবে বা অত টাকা জমাতে, আমাকে প্রমোশন পেতে হবে বা ইত্যাদি, আমাদের মৃত্যু কবে হবে সেটা নির্ধারণ করা আছে। আপনি চিন্তা করেন আপনাকে কী কী করতে হবে কিন্তু যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঠিক করেন যে আমি আজ রাতে মারা যাব তাহলে যা নির্ধারিত তা হবেই! এবং আমি চলে যাওয়ার পরে আমার সন্তান, আমার স্ত্রী, আমার স্বামী বা যেই হোক না কেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইতিমধ্যেই তাদের দেখাশোনা করছেন। আমি তাদের দেখাশোনা করছিলাম এটাই আমার কখনো ভাবা উচিত না। আমি তাদের দেখাশোনা করছিলাম না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই সবসময় তাদের খেয়াল রাখছিলেন। আমিই নিজেকে ভোলাচ্ছিলাম এই ভেবে যে এসবকিছু আমার ওপর নির্ভর করে, কোন কিছু আমার ওপর নির্ভর করে না; কিছুই না! কারও ভালো করার ক্ষমতা আমার নেই। সকল ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার।

আপনার মধ্যে ইগো তখনই জন্মায় যখন আপনি প্রকৃতভাবে আল্লাহর মাহাত্ম্যকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। তখন আপনি আল্লাহকে প্রশংসা করার স্থানে নিজের ব্যাপারে উচ্চধারনা পোষণ করতে শুরু করেন। তখনই এটা শুরু হয়; এটাই এই সমস্যার ভিত্তি গড়ে দেয়। তাই প্রথম যে পয়েন্টটা আমি বলবো ইনশাআল্লাহ তা হল অনেক মানুষই ধর্মের বেশ ধরে থাকে। তাদেরকে দেখে ধার্মিক মনে হয়, তারা ধর্মীয় কথা বলে, তাদের জ্ঞানও আছে। আল্লাহ যেন আমাদের এ থেকে রক্ষা করেন। এটা খুবই গুরুতর সমস্যা। এদেরকে যে মানুষটার দাড়ি নেই তাঁর থেকে বেশী প্র্যাকটিসিং মনে হয়। অনেক বোনদের যেসব বোনেরা হিজাব পালন করেন না তাদের তুলনায় বেশী আল্লাহভীরু মনে হতে পারে। তাদেরকে বাইরে থেকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে ইগো আছে। আপনার ভেতরে অন্যের সামনে নিজেকে মহানরূপে উপস্থাপন করার তাড়না কাজ করে। আপনার মনে হয় যে আপনি বেশী ধার্মিক, বেশী যোগ্য, আপনি অন্যদের থেকে ভালো অবস্থানে আছেন। আর আপনি যদি মনের ভেতর আরেকজন মুসলিমকে ছোট করে দেখেন তাঁর অবস্থা যেমনই হোক না কেন, তাহলে আপনার হৃদয়ে যে জিনিসটা বাসা বেধেছে তা হল ‘কিবর’। অহংকার। আর আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপদেশ থেকে জানতে পারি যে, যাদের হৃদয়ে সরিষাদানার সমান, অর্থাৎ বলতে গেলে কিছুই না, এমন অণু পরিমাণ অহংকার থাকে তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খোলা নেই।

তাই আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, ধরুন একজন মুসলিম খারাপ কাজ করে। হয়তো সে মদ্যপান করে বা যেকোনো ধরনের খারাপ কাজ করে। তাঁর কুকর্মগুলো বাহ্যিক, চোখে দেখা যায়। কিন্তু আপনার খারাপ কাজটা কোথায় ঘটছে? অন্তরের মধ্যে। বাইরে থেকে আপনাকে দেখতে ভালোই লাগে। মনে হয় যে আপনি ঠিকঠাকই আছেন। নিঃসন্দেহে সেই লোকটা তাঁর খারাপ কাজগুলোর কারণে শাস্তিযোগ্য। আপনার খারাপ কাজটাও কি নয়? আর যদিও কেউ তাঁর কাজগুলোকে উপেক্ষা করছে না; কিন্তু যদি তুলনা করা হয় তাহলে আপনার আর তাঁর মধ্যে কার সমস্যাটা দূর করা বেশী কঠিন? এদিকটা ভেবে দেখেন। জানেন দাম্ভিকতা দূর করাটা বেশী কঠিন কেন? কারণ আপনি একে দেখতেও পান না। সেই মানুষটার মদ্যপান ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ নিয়ে তাঁর সাথে কথাও বলা যাবে। কিন্তু অন্তরের এই ব্যাপারটা সমাধান করা অনেক বেশী কষ্টের, আর একমাত্র যে ব্যক্তি এটা অনুভব করতে পারে সে কে? আপনি। অন্য কেউ আপনাকে এটা বলতে পারবে না। আমরা কেউ অপরকে এই সম্পর্কে বিচার করতে পারব না। আর আমি যখন আপনাদের এই ব্যাপারে কথা বলছি এসময় আপনার যেন এমনটা মনে না হয়, “আমার অহংকারী একজনের কথা মনে পড়ছে যার এই কথাগুলো শোনা উচিত” তাহলে আপনার এই চিন্তাই তো অহংবোধের চিহ্ন। কার কথা আপনার মনে আসা উচিত? আপনার নিজের। ধর্মের নাসীহাগুলো প্রথমত কার জন্য প্রযোজ্য? নিজের জন্য। আমরা এতই অন্ধ হয়ে গেছি যে আমরা ভাবি, কুরআনের আদেশ-নিষেধ, রাসুল (সাঃ) এর উপদেশগুলো কেবল অন্যদের জন্য। প্রথমে সেগুলো কার মানার কথা ছিল? কার সেগুলো প্রথমে অন্তরে পালন করা দরকার ছিল? আপনার নিজের। এই ব্যাপারটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর হয়ে পড়ি। যখন একজন মানুষ স্বামীর অধিকার সম্পর্কে কোন হাদিস জানতে পারে, তারপর সে প্রথমে কি করে? সে তাঁর স্ত্রীকে যেয়ে বলে “জানো আজকে আমি কি শুনেছি? মনে রেখো….”। একইভাবে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের প্রথম কোন আয়াতটা শোনায়?

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
“তোমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার করো”।

এটা কি আত্মসেবা হয়ে যায়না? আমরা কি এখানে নিজেদের সেবা করতে এসেছি নাকি আল্লাহর দ্বীন পালন করতে এসেছি? এটা পুরো আচরণই বদলে দেয়। তো এটিই প্রথম সমস্যা যা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম- ইগো, যা কেবল আপনিই উপলব্ধি করতে পারবেন। আর কেউ সেটি আপনার জন্য তা করতে পারবে না। যদি অন্তরের মধ্যে ইগো থাকে তাহলে বাইরে থেকে যতই ভালো দেখাক না কেন তার কি আর কোন মূল্য থাকবে? না। কারণ তার হৃদয়টা সুস্থ নেই। আর আল্লাহ বলেছেন,

إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
“(যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না)… কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।”

তাই আমাদের ভেতরের এই ইগোটাকে ঠিক করতে হবে। দ্বিতীয় পয়েন্টে যাওয়ার আগে আপনাদের কিছু টিপস বলি কিভাবে বুঝবেন যে আপনার মধ্যে ইগো জন্মেছে। যদি কেউ আপনাকে কোন বিষয়ে শুধরে দেয় আর আপনি খুবই অপমানিত বোধ করেন, আপনার যদি মনে হয় “ তুমি কিভাবে আমাকে এটা বলতে পারলে, হ্যাঁ? নিজেকে কী মনে করো?” “তার কী এমন যোগ্যতা আছে আমার ভুল ধরিয়ে দেবার?” এটা যদি আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় তবে আপনার মধ্যে ইগোর এই সমস্যা আছে। সেই লোকটা যদি ভুল হয়েও থাকে, তার হয়তো সেটা বলা উচিত হয়নি। তারপরও আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমন হবে না যে “সে আমাকে কী করে এমন কথা বলে?” । বরং আপনার প্রতিক্রিয়া হবে, “হয়তো এই অনুচিত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমাকে আমার নিজের কোন দিকে নজর দিতে ইঙ্গিত করছেন। তাঁর কথার মধ্যে সামান্য অংশও কি সত্য? এর মাঝে কি এক পারসেন্টও সঠিক? তাঁর কথার মধ্যে যতটুকু সত্য সেটুকুই আমি গ্রহণ করি। আমার নিজেকে বাঁচাতে হবে”। “সে কে আমাকে এগুলো বলার?” নিজের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলবেন না। বাজে কথার মধ্য থেকেও ভালটুকু বের করে আনুন আর বাকিটা বাদ দিন।

যদি আপনার ভেতর সব আলাপের মাঝে অংশও নেওয়ার তাড়না কাজ করে; যদি আপনার মনে হয় আলোচনার মধ্যে যেকোনোভাবেই নিজের মতামত অন্যদের শোনাতেই হবে; আলোচনা শেষে আপনার মত গ্রহণ না করা হলে আপনি যদি খুবই অপমানিত বোধ করেন; হয়তো আপনি একটা মত দিয়েছেন আর অন্যজন আরেকটা মত দিয়েছে, আর শেষে তাঁর মতটাই গ্রহণ করা হয়েছে। আর তখন আপনি রাগান্বিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। তাহলে আপনার ইগো প্রবলেম আছে। বিশেষ করে ধর্ম সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে যদি এমনটা হয়। হতে পারে কোন মসজিদে বসে কয়েকজন কোন বিশেষ ব্যাপারে তাদের কি করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করছে। সেখানে আপনি আপনার মতামত দিলেন, সাথে অন্যেরাও দিল। আর এই আলোচনা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হচ্ছে, তাইনা? আপনি মসজিদ বিষয়ে অথবা অন্য কোন ব্যাপারে যে মতটা দিলেন সেটা কাকে খুশী করার উদ্দেশ্যে? আল্লাহকে। আপনি তো সেটা নিজের জন্য আর দেননি। “দেখা যাক আমার মতামতটাই প্রাধান্য পায় কিনা।” এটা তো আপনার লক্ষ্য ছিলনা; আর যদি সেজন্যই দেন তাহলে আপনার চিন্তায় বিরাট সমস্যা রয়েছে। তো আপনি যদি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কোন বিষয়ে আন্তরিক মত দেন তাহলে কি আপনি সেজন্যে সাওয়াব পেয়ে গেলেন না? আল্লাহই আপনাকে আপনার প্রাপ্য পুরস্কার দেবেন। তাই লোকেরা আপনার মত গ্রহণ করুক বা না করুক সেটা নিয়ে আপনি আর চিন্তা করবেন না, আপনি যেই জিনিসটা চেয়েছিলেন তাতো পেয়েই গেছেন। কিন্তু আপনার নিয়ত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না হয় তাহলে কী হবে? আপনি মনে মনে কষ্ট পাবেন। আপনি বলবেন “ না, আমি আমার মত দিয়েছি যেতে এটাই প্রধান মত হয়। আর সেটা না হওয়াতে আমি অপমানিত বোধ করছি।” এভাবে নিজেকে সহজে যাচাই করা যেতে পারে। যদি আপনি কষ্ট পান তাহলে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। এ ব্যাপারগুলো চর্চা করা অনেকটাই কঠিন। তারপরেও আমাদের নিজেকে যাচাই করা চালিয়ে যেতে হবে।

সুতরাং প্রথম অদৃশ্য সমস্যাটা হল ইগো; যাদের বাইরে থেকে ধার্মিক মনে হয় কিন্তু তাদের ভেতরে নিজেকে অন্যদের থেকে বড় করে উপস্থাপনের তাড়না কাজ করে। দ্বিতীয় সমস্যাটাও অনেকটা একই ধরনের। বাইরে থেকে বেশ ভালো লাগে, জ্ঞানী মনে হয়, মুখে ভালো কথাও বলে, ভালো পোশাক পরে, সবকিছুই চমৎকার! তাকে দেখে যে কেউ বলবে, “এই ভাইটা আসলেই অসাধারণ একজন মানুষ!” কিন্তু ভেতরে ভেতরে কি হয় জানেন? প্রথম ক্ষেত্রে নিজের মধ্যে ইগো জন্ম নেয় আর দ্বিতীয় সমস্যা হল হৃদয় কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আল্লাহর কথা আপনাকে আর নাড়া দেয় না, কুরআন শুনেও আপনি কিছু অনুভব করেন না। অনেকদিন হয়ে গেছে আপনি সালাতে দাঁড়িয়ে কাঁদেন না, আপনার হৃদয়ে কোন অনুভুতি ছুঁয়ে যায়না। আপনি নিয়মিতই তা শুনে যাচ্ছেন আর আপনার শুধু মনে হয় “আমি তো এগুলো আগে থেকেই জানি।” “আমার এসব শুনে লাভ নেই, এগুলো তো আমি অনেক আগেই শুনেছি। আমি জানি এরপর তিনি কি বলবেন।” সালাতে দাঁড়িয়ে আপনি ভাবতে থাকেন “ইমাম সাহেবের তিলাওয়াতটা আরো শুদ্ধ হতে পারতো…তাঁর ক্বলক্বলাটা ঠিক হয়নি… আহা, তিনি মাদ্বটাও যথেষ্ট লম্বা করেননি।” এসবই আপনার সালাতের মাঝে হচ্ছে। এটা কীসের লক্ষণ জানেন? আপনার তাজবীদ ভালো কিন্তু হৃদয় কঠিন। আল্লাহর কালামও আপনাকে নাড়া দেয় না? সেগুলো শুনেও আপনার মনের মধ্যে কিছু বয়ে যায়না? আপনি কেবল সেগুলোকে অবচেতনভাবেই শুনে যাচ্ছেন।

একদিকে আপনার ঈলম বৃদ্ধি পাচ্ছে, লোকজনের সামনে আপনাকে খুবই ধর্মভীরু বলে মনে হয়, কিন্তু যেসময় একা থাকেন, যখন আর কেউ আপনাকে দেখতে পায়না তখন আপনার ভেতরের খারাপ সত্ত্বাটা বেরিয়ে আসে। যার কিছু আলাদা আচরণ আছে; যে কিছু গোপন কাজ করে। তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরা দেখে কেউ বলতেই পারবে না যে সে এরকম খারাপ কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা নির্জনে একদম ভিন্ন এক মানুষে রূপ নেয়, যাকে দেখে আপনি চিনতেও পারবেন না। তো সেই মানুষটার ভেতরে একটা দানব বাস করছে। তার কিছু সাংঘাতিক সমস্যা আছে, কিন্তু তাকে বাহ্যিক দিক থেকে অনেক ভালোই লাগে। কেউ আপনার এই সমস্যা দূর করতে পারবে না কারণ তারা জানেও না যে আপনার ভেতরে এমন সমস্যা বিরাজ করছে।

তাই প্রথম সমস্যা হলো ইগো, দ্বিতীয়টা হলো কঠিন হৃদয়; আর এ দুটোই আত্মিক সমস্যা, সমস্যাগুলো হৃদয়জনিত। কেবল আপনিই নিজেকে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ্‌ শেষের দিকে যেয়ে এ সমস্যাগুলো দূর করার জন্য কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করবো। আমি দ্বিতীয় পয়েন্টটা গুছিয়ে আনতে চাই, হৃদয় কঠিন হয়ে পড়ার ব্যাপারে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, যে আয়াতটা আমি শুরুতে তিলাওয়াত করেছিলাম সুরা হাদীদ থেকে, সেখানে আল্লাহ প্রথমে আহলে কিতাবদের সাথে এবং তাঁর পরে আমাদের সাথে কথা বলছেন; তিনি বলেন,
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ
“যারা ইমান এনেছে তাদের কি এখনো সময় আসেনি…”

أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ
“…..যে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে যাবে, তাদের হৃদয় সশ্রদ্ধ ভয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে?”

যখন আপনার পেশী নরম আর দুর্বল হয়ে পড়ে, জানেন সেটা আসলে খুশু’। তখন পেশীগুলোকে শক্তিহীন মনে হয়। আপনার মনে হয় যে কেউ আপনাকে বশীভূত করে ফেলছে। আল্লাহ বলছেন তাদের হৃদয় আল্লাহর ভয়ে, তাঁর কথা স্মরণ করে বশীভূত হয়ে পড়বে।

“যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে তার কারণে হৃদয় গলে যাওয়ার সময় আসেনি?…”

وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ
“…এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে তার কারণে?”

আর সেই সত্যটা কী? আল কুর’আন।

 

তারপর আল্লাহ একই আয়াতে একটি সতর্ক বাণীও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন : وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ তারা (মুমিনরা) যাতে তাদের মত না হয়, যাদেরকে তাদের পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল।فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ তাদের উপর একটি বড় সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তার মানে তারা এই কিতাব ধারণ করেছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য। যখন তারা এভাবে কিতাব ধারণ করেছিল, আপনারা জানেন – যখন আপনি প্রথম ধর্মীয় অনুশাসন মানা শুরু করেন, আপনি এ ব্যাপারে খুবই উত্তেজিত থাকেন। এই উত্তেজনা একসময় চলে যায়, যা থাকে তা হলো বহিরাবরণ। সুতরাং ঐসব লোকদের ক্ষেত্রে কী ঘটল? فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল। একটি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর, ধর্মীয় কর্ম সম্পাদন একটি রুটিনে পরিনত হয়ে গেল। এমন কিছু যা তারা শুধু করে, যা করতে হয়, তারা এটা করছে কারণ এটাতে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু এটা আর এমন কিছু নয়, যা তাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে। তাদের হৃদয় হয়ে গেছে কঠিন।

আর যখন আপনার অন্তর কঠিন হয়ে যায়, তখন কলুষিত হওয়া আপনার জন্য খুবই সহজ। এজন্য আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে- وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ তাদের অধিকাংশই পাপাচারী। তাদের বড় একটা সংখ্যা আসলে খারাপ।আয়াতটি শেষ হয়েছে আহলে কিতাবদের দিয়ে , আর এটা কি দিয়ে শুরু হয়েছিল? আলোচনাটি আসলে তাদের নিয়ে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর কিভাবে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।

আর এটা যদি আপনি আপনার ভেতরে অনুভব করতে পারেন, কেউ আপনাকে এটা বলে দিতে পারবে না। আমি আবার বলছি, আপনার জন্য কেউ এটা অনুমান করতে পারবে না। একমাত্র যে এটা ধরতে পারবে সে ব্যক্তি হলো আপনি নিজে, অন্য কেউ নয়। আপনি আল্লাহর সামনে কতটুকু বিনয়ী, আপনি অন্যদের সামনে কতটুকু বিনয়ী এ বিষয়টা আমরা আপনাকে বলে দিতে পারব না, একমাত্র আপনি আপনার এই বিষয়টা ভালো বলতে পারবেন।

আপনি যদি কখনো হতাশায় ভোগেন, আপনি বুঝতে পারছেন যে আপনার অন্তর আসলেই কঠিন হয়ে গেছে – আর আপনি নিজেই এই সমস্যাটা আপনার মধ্যে বাড়তে দিয়েছেন। কখনো কখনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি খুবই ভীতিকর মনে হয়। তাদের সাথে কথা বলা কঠিন, তাদের আশে পাশে যাওয়া আতংকজনক কারণ তারা হয়ত আমাকে অপমান করতে পারেন। আপনি তাদের ভয়ে ভীত থাকেন। অনেক সময় যেসব বোন্ হিজাব পরেন না তারা হিজাব পরা একজনকে আসতে দেখলে রাস্তা ক্রস করে অন্য দিকে চলে যান। তারা মনে করেন – ঐ যে হিজাব পুলিশ আসছে!! সে নিশ্চয়ই আমাকে কিছু বলবে, আমার মন খারাপ করে দিবে।
এখন- একদিকে এটা একটা ভয়ের কারণ, অন্যদিকে কখনো কখনো এটা সত্য যে , কিছু মানুষ রয়েছে যারা অন্যদের নিচু চোখে দেখে, তারা অন্যদের প্রতি উদ্ধত। ’’আমাকে বল – কয়েকদিন আগে না তুমি পার্টি মাতিয়ে রাখতে!’’ যারা আপনার সাথে এভাবে কথা বলে তাদেরকে আপনি কিভাবে জবাব দেন? আপনি কি ভুলে গেছেন যে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আল্লাহ আপনাকে কোথায় এনেছেন। কারণ মানুষ ভুলে যায়, মানুষ ভুলে যায় যে তারা কি ছিল আর আল্লাহ তাদের কোথায় এনেছেন।

তারপর কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওযার পর, যখন তারা এমন কাউকে দেখে যে পার্টি এনিম্যাল – তারা তখন বলে উঠে , আস্তাগফিরুল্লাহ, সে এমন হলো কিভাবে? আপনি কোথায় ছিলেন? এই লোককে দেখেতো আপনার নিজের কথা মনে হওয়া উচিত। আপনিতো ঠিক তার মতই ছিলেন। আল্লাহর যে রহমত আপনার উপর বর্ষিত হয়েছে তা আপনার স্মরণ করা উচিত। وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ আপনি অগ্নিকুন্ডের একেবারে প্রান্তসীমায় ছিলেন। فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا তিনিই আপনাকে রক্ষা করেছেন। আর সেই আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন, فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ তিনি তোমাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করেছেন। (৩:১০৩)

আপনারা আপনাদের অন্তরসমূহের মাঝে যদি ভালবাসা পেতে চান, তাহলে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে আপনি নিজেও অগ্নিকুন্ডের কিনারায় ছিলেন, আপনাকে সেখান থেকে রক্ষা করা হয়েছে। আর আপনাকে এইজন্য রক্ষা করা হয়নি যে – আপনি খুবই স্মার্ট মানুষ তাই আপনি রক্ষা পাওয়ার যোগ্য। এটা আপনার প্রতি কার অনুগ্রহ ছিল? এটা আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ছিল। কোন সাহসে আপনি অন্যদের দিকে এভাবে তাকান এবং এভাবে চিন্তা করেন।
এই দাম্ভিকতা জঘন্য ব্যাপার, এটা আপনার সকল ভালো কাজ ধ্বংস করে দিবে। এটা সব ভালো ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। অধিকাংশ সময় আমাদের যুবকরা যারা তীব্র বিতর্কে লিপ্ত হয় – যেকোনো বিষয় নিয়ে এটা হতে পারে যেমন ধর্মতত্বের বিষয়, ফিকহ সম্পর্কিত বিষয়, এটা সংঘঠনের পদ নিয়ে হতে পারে – যেকোনো ব্যাপার নিয়েই এটা হোক না কেন, আপনারা জানেন বিতর্কের মূল কারণ কী? ইগো। আসলেই এটা আত্ম-অহংকার এর কারণে।

মানুষ স্কলারদের সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা কোনো ক্রীড়াবিদকে নিয়ে কথা বলছে। ”ঐযে উনি! আমি ওনার কথা একদম পছন্দ করি না।” আমাকে মাফ করবেন। আপনি জানেন তিনি কত পরিশ্রম করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য! যদি আপনি তার সাথে একমত নাও হন। প্রকৃত ব্যাপার হলো তিনি তার বাড়ি ত্যাগ করেছেন। তিনি যে স্কলারই হন না কেন- তিনি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমন করেছেন শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য, রাতের পর রাত ব্যয় করেছেন প্রার্থনা করে, মুখস্ত করে, অধ্যয়ন করে। আর আপনি কি তার সম্পর্কে এমন একটা মন্তব্য করে বসলেন যে , তিনি কি বলছেন আমি পছন্দ করি না আমার মনে হয় তিনি বিপথগামী। কোন সাহসে আপনি এটা বলেন!! আপনি কি করেছেন?? কিসে আপনাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যায় যে আপনি তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন??

আপনি যে কোনো মুসলিমের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন আর আপনি মনে করতে পারেন যে তারা সঠিক নয়। এক্ষেত্রে তাদের প্রতি আপনার প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন হওয়া উচিত? আপনার কি এমন রায় দেয়া উচিত যে তারা জাহান্নামের পথে, নাকি আপনার সত্যিই তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? আর আপনি যদি তাদের ব্যাপারে সত্যিই উদ্বিগ্ন থাকেন তাহলে তাদের ব্যাপার নিয়ে আপনি অন্যদের সাথে কথা বলবেন না, বরং কার সাথে কথা বলেবেন? সরাসরি তাদের নিজেদের সাথে। আপনি সরাসরি তাদের সাথে কথা বলবেন। যদি আপনার মাঝে আন্তরিকতা থাকত তাহলে আপনি আপনার উদ্বেগ উৎকন্ঠার কথা সরাসরি তাদের বলতেন অন্যদের নয়। অন্যথায় আপনার মাঝে আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে যা প্রদর্শিত হয় তা হলো আপনার ইগো, আপনার নিজ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন, নিজ মতের পক্ষে দাড়িয়েছেন আর অন্যদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করছেন। এটা অপরিপক্ব, দাম্ভিক এবং আত্ম-অহংকারমূলক। এটা ঠিক তাই।

যদি আমাদের অবস্থা এই পর্যায়ে এসে পৌছে, তাহলে আমাদের প্রতিষেধক প্রয়োজন। সর্বপ্রথম প্রতিষেধক হলো আশা (hope) . আশা হারিয়ে যায়নি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পরবর্তী আয়াতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বলেছেন- সুবহানাল্লাহ- اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا
তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহই ভূ-ভাগকে তার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন।

পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ অন্তরসমূহ সম্পর্কে কথা বলছিলেন। আর এখন তিনি কি বিষয়ে কথা বলছেন? ভূপৃষ্ঠকে জীবন দেয়া সম্পর্কে। আল্লাহ আপনাদের বলছেন যে , যেভাবে আল্লাহ পৃথিবী পৃষ্ঠকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করতে পারেন ঠিক সেভাবে আল্লাহ আপনার মৃত অন্তরকেও পুনরায় জীবিত করতে পারেন।
আপনার অন্তর পুনরায় কোমল হতে পারে। এটা প্রত্যাশার বাইরে নয়। আমরা অলৌকিক নিদর্শনাবলী প্রকাশ করছি যাতে তোমরা বুঝতে পর। বুঝতে পেরেছেন? আপনাদের জন্য আশা রয়েছে। আপনি আপনার অন্তরকে পরিষ্কার করে নিতে পারেন। এটা সম্ভব। আল্লাহ যদি শুষ্ক জমিনে প্রানের সঞ্চার করতে পারেন তিনি আপনার অন্তরকেও পুনরায় জীবিত করতে পারেন।

এখন চিকিতৎসার ব্যাপারে আলোচনা করা যাক। এই চিকিৎসা কি? আপনি আপনার ইগো সমস্যার সমাধান কিভাবে করবেন? প্রথম যে বড় বিষয়টি আপনার অন্তর পরিষ্কার করতে সহায়তা করবে তা হলো – আল্লাহর স্মরণ। প্রথম এই বিষয়টি আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে।কত ঘন ঘন আপনি আল্লাহকে স্মরণ করেন। আল্লাহকে স্মরণ করা মানে শুধু সুবহানাল্লা, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা নয়। আর এগুলো অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিকর যা আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ থেকে জানতে পারি। কিন্তু এই জিকর গুলো যদি চিন্তাহীন হয়, আপনি যদি এগুলোর অর্থ ও মাহাত্ম না বুঝেন এবং এগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা না করেন তাহলে এটা জিকর নয়। এতে শুধু মুখস্তটা আরেকবার রিভাইস দেয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না।

আলহামদুলিল্লাহ অর্থ হলো – সকল কৃতিত্ব, সুনাম, প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহকে সবকিছুর জন্য প্রশংসা করতে হবে এবং ধন্যবাদ দিতে হবে। ধরুন, কখনো আপনার একটা খারাপ দিন গেল , আপনি কি বলবেন? আলহামদুলিল্লাহ। আমি শুধু আল্লাহকে ধন্যবাদ দেই না আমি তার প্রশংসাও করি। যাই এখন ঘটছে তা অবশ্যই ভালো এবং এটা এত ভালো যে আমি এর জন্য তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আর আমি শুধু তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না আমি তার প্রশংসাও করি। কী দারুন কাজ তিনি করেছেন! আপনি সমস্যায় পড়া সত্বেও বলেন আলহামদুলিল্লাহ।

কিন্তু যখন আপনি এর অর্থ বুঝে বলবেন তখন এটা অন্য কিছু। এখন আপনি আসলেই আল্লাহকে স্মরণ করছেন। আল্লাহর এই প্রশংসা , আল্লাহকে কৃতিত্ব দেয়া আপনাকে আপনার নিজের সম্পর্কে কী শিক্ষা দেয়? যখনি কোনো ভালো কাজ আপনি মনে করেন যে আপনি সম্পাদন করেছেন, আপনার তখন কি বলা উচিত? আলহামদুলিল্লাহ। আপনি আসলে কাকে এই কাজের কৃতিত্ব দিলেন? আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাকে। আপনি কোনো বক্তব্য দেয়ার পর হয়তো কেউ এসে আপনাকে বলে, ভাই দারুন বক্তব্য দিলেন। আপনি হেসে বললেন – আলহামদুলিল্লাহ, আমি জানি ভালো হয়েছে।

তাহলে এই আলহামদুলিল্লাহ আসলে আলহামদুলিল্লাহ নয়।
তাহলে এভাবে বলার মাধ্যমে প্রকারান্তরে আপনি নিজের প্রশংসাই করলেন। প্রশংসা পেলে কিভাবে অস্বস্তিতে পড়তে হয় আপনাকে তা শিখতে হবে। প্রশংসা আপনার মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করা উচিত। আল্লাহকে কৃতিত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে দ্রুত হতে হবে এবং একই সাথে নিজেকে বিনম্র করে দিতে হবে। ‘’ভাই আপনি জানেন না, আপনি জানেন না। আপনার এভাবে বলা ঠিক নয়। আমি আসলে কিরকম তা আপনি জানেন না আল্লাহ জানেন। শুধু আমার জন্য দোআ করবেন। আপনার প্রশংসার আমার দরকার নেই, আমার দরকার আপনার দোয়া।”

আমি চাই না আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিন। বোন আমি খুবই ভালো এটা আপনি আমাকে বলার দরকার নেই, না আমি আপনার কাছ থেকে এটা শুনতে চাই না। এটা আসলে আমাকে সাহায্য করে না , এটা আমার ক্ষতি করে। কারণ যখন কেউ আমাকে বলে আমি কত ভালো ! এটা আমার মাঝে কী জাগিয়ে তোলে? আমার ইগো। আর এটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সমস্যা। তাই কেউ অন্য কারো প্রশংসা করার মাধ্যমে তার উপকার করছে না।আর নম্রতা সম্পর্কে শেষ যে বিষয়টা আমি এর সাথে যোগ করতে চাই তা হলো – যখন কেউ আপনাকে বাজে কথা বলে বা আপনাকে অপমান করে – এটা আসলে আপনাকে বিনয়ী করতে সাহায্য করে। তারা হয়তো আপনার প্রতি একটা অনুগ্রহ করলো। তারা মনে করতে পারে তারা আপনাকে ছোট করতে পেরেছে কিন্তু এটা হয়তো আল্লাহর তরফ থেকে একটা মেসেজ বা উপহার আপনার জন্য। এর মাধ্যমে আল্লাহ আপনাকে নম্রতা উপহার দিলেন। এই জন্য ইবন তাইমিয়্যাহ র বলতেন – যখন কেউ আমাকে কষ্ট দেয় আমি মনে করি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার, তিনি আমাকে নম্রতা শিক্ষা দিচ্ছেন। এটা একটি ব্যাতিক্রমি উদাহরন।

এরপর মানুষের উপকার করা শিখুন, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।অনেক সময় কেউ কেউ সাধ্যের অতিরিক্ত করে ফেলে। ধার্মিকদের প্রতি এটাই আমার শেষ বক্তব্য, বিশেষ করে তরুণদের জন্য। তারা অনেক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, তারা সংগঠনে অংশ নেয়, কোন দলে যোগদান করে, মসজিদে যোগদান করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যায়, তারা সবসময় কর্মঠ থাকে আর নিজেদেরকে ক্লান্ত করে ফেলে একের পর এক অনুষ্ঠানের কাজ করে। এরপর কি ঘটে জানেন? তারা ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে ফেলে। তারা পুরোপুরি ক্লান্ত হয়ে যায়, এবং এরপর আর কখনই আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনা। ভারসাম্য রাখুন, ধীরে ধীরে অগ্রসর হউন। এক সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে সব করতে হবে এমন কোন কথা নেই, অথবা এক গ্রীষ্মের ছুটিতেই সব করতে হবে এমন নয়। বরং ধীরে ধীরে এগোন।

ইনশাল্লাহ আপনি গতি ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু যখন আপনি শুধু আল্লাহ্‌র জন্যই কিছু করবেন, আর আপনি হতাশ হয়ে যান যে কোন ফলাফল আসছে না, উদাহরন হিসেবে এই অনুষ্ঠানের কোথায় বলা যাক, আমাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল, আমি বলে ছিলাম, ঠিক আছে আমি রবিবার আসব। শনিবার রাতে কেন নয়? কারন তখন কেউ এখানে থাকবেনা। জানেন আমার প্রথম মতামত কি ছিল? “তো কি হয়েছে?”। আমি আপনাদের জন্য এখানে আসছিনা, আমি কেন আসছি? আরও বড় কোন কারনে। আপনারা আমাকে কিছু দিচ্ছেন না, কে দিচ্ছেন? ঠিক? তাই এইখানে ১ জন থাকুক, ১০০ জন থাকুক আর কেউ না থাকুক, আমি কি আমার বিনিময় পাব যদি আমার নিয়ত ঠিক থাকে? আমি পেয়েছি, যদি আমার নিয়ত ঠিক থেকে থাকে।

 

আপনি এখানে কেন এসেছেন? আপনি কি এখানে এসেছেন কারণ আপনার বন্ধুরা এসেছে বলে? কারণ আপনাকে আসতে জোর করা হয়েছে? আপনার গাড়ি আজ ছাড়ছে না, তাই আপনি আটকে গেছেন এখানে। এজন্য? তাহলে আপনি কিছুই অর্জন করতে পারলেন না।কিন্তু আপনার এখানে আসার কারণ এবং নিয়ত যদি এরকম হয়-“আজ রাতে আমি আল্লাহ্‌ কে স্মরণ করব, আমি আল্লাহ্‌র আরোও নিকটবর্তী হব। এমনকি যখন কিছু হচ্ছে না, আপনি সেটার অপেক্ষায় আছেন। এ অপেক্ষার সময়টাও আপনার স্বপক্ষে পূণ্য হিসেবে গণ্য হবে। শুধু দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নিয়তের পরিবর্তন। ঠিক আছে? এটি আপনাকে জীবনভর অনেক সাহায্য করবে। কারণ আপনি যখন কিছু করবেন, যেমন- প্রচারপত্র দেওয়া, মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া এবং কেউ কোন আগ্রহ দেখাল না এবং আপনি হয়তো মনে মনে বলবেন-কেউ কিছু শুনতে চায় না। কিন্তু আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন না। কেন জানেন? কারণ, কেন আপনি প্রচারপত্র গুলো বিলি করছিলেন? কেন আপনি দাওয়াত দিচ্ছিলেন? কোথায়, কার আছে আপনার প্রত্যাশা? (আঙুল ঊর্ধ্বমুখী, মানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে।)আপনার কাজ চেষ্টা করা। ফলাফল তাঁর কাছে। আপনি এই ফলাফলের দায়িত্বে নন। আপনি যখন এটাকে আন্তরিক ভাবে মেনে নিতে পারবেন,তখন জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে। এবং নিজের প্রতি অনেক সন্তুষ্ট থাকবেন। আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন না।’ ‘সেখানে মাত্র অল্প কিছু মানুষ, তাদের সংখ্যা আরোও বেশি হতে পারত।’ ‘ হ্যাঁ,সেখানে আরো মানুষ থাকতে পারত কিন্তু সেটি আল্লাহ্‌র হাতে। আমি কি আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি? আমি কি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি? শুধুমাত্র এটাই নিজেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং আমার চেষ্টা কি সত্যিই আল্লাহ্‌র জন্য ছিল? এই প্রশ্নটিই নিজেকে করতে পারেন।

আমি এসব আলোচনায় আনছি কারণ ‘নিয়ত’ এমন কিছু নয় যা আপনি জীবনে একবারমাত্র করেন। জীবনে একবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যে আল্লাহ্‌র রাস্তায় কাজ করবেন, একজন ভালো মুসলিম হবেন। আপনি সেই ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন কিন্তু সেই ‘ইচ্ছা’ তে মরিচা পড়তে পারে, তাই বার বার নিয়ত ঠিক করে নিতে হবে। এবং আপনি জানেন(?) সবাই ভাবছে যে আপনার ইচ্ছা অনেক শক্তিশালী কারণ তারা শুধু আপনার বাইরেটা দেখছে। তারা কী দেখে না? ভেতরেটা। এবং যেহেতু তারা শুধু বাইরেরটা দেখে, তারা আপনাকে বলবে,”আপনি খুবই ভালো একজন মানুষ।” এবং আপনি তাদের বিশ্বাসও করা শুরু করবেন, যার ফলে আপনি সমস্যাটাকে আপনার জন্য আরো ভয়াবহ করে তুলছেন।

প্রথম প্রতিকার হচ্ছে-আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কে স্মরণ করা। দ্বিতীয় প্রতিকার হচ্ছে- উত্তম সঙ্গী-সাথী খোঁজা। এমন সহচর খোঁজা যারা আপনার চেয়ে উত্তম। তৃতীয় প্রতিকার, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার-নিজের মুখ বন্ধ রাখতে শেখা। নিজের মুখ বন্ধ রাখতে শেখা। যদি আপনি খুব খারাপ কিছু দেখেন তাহলে একজন মুসলিমকে উপদেশ দেওয়ার নমনীয় পন্থা খুঁজে বের করুন। এভাবে ভাবুন- “আমি তাদের যে কথা গুলো বলতে যাচ্ছি, সেগুলো কি তাদেরকে ধর্মের প্রতি আরো বিমুখ করে দিবে?” অথবা আমার সৌহার্দপূর্ণ,নমনীয় পন্থা খুঁজে বের করা উচিৎ যা তাদের ইসলামের মুল বিষয় গুলোর সাথে আপস না করে দ্বীনের আরো নিকটে নিয়ে আসবে। হয়ত তাদের সহচরদের পরিবর্তনের মাধ্যমে, দৃশ্যপটের পরিবর্তনের মাধ্যমে, হয়ত যদি তারা সামান্য একটু উপদেশ শুনতে পায়…

আপনি প্রথমেই তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে চান না, আপনি প্রথমে কী পরিবর্তন করতে চান? তাদের অন্তর। যখন তাদের অন্তর পরিবর্তন হবে তখন ব্যবহার আপনাআপনি পরিবর্তন হবে। বেশির ভাগ সময় আমরা মানুষের কিসের পিছে ছুটি? আমরা তাদের ব্যবহার এর পেছনে ছুটি। আপনি মানুষের ব্যবহার পরিবর্তন করতে পারবেন না। আপনি শুধু তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন এবং আশা করতে পারেন আল্লাহ্‌ তাদের অন্তরকে পরিবর্তন করে দিবেন। আপনার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া “ফাযাক্কির”(অতঃপর স্মরণ করিয়ে দিন)। আল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও্রয়া সাল্লাম মানুষদের আল্লাহ্‌র সাথে শিরক করতে দেখেছেন, কুফরি করতে দেখেছেন এবং আল্লাহ্‌ তাদের বলেছেন,” فَذَكِّرْ إِن نَّفَعَتِ الذِّكْرَىٰ ‘ ‘স্মরণ করিয়ে দাও, স্মরণের উপকারিতা আছে ”(৮৭-১০)।মহানবী (সাঃ) এই একই ধরনের খুব খারাপ মানুষদের কাছে দশ বছর দাওয়াত দিয়েছেন এবং আল্লাহ্‌ বলে গেছেন,”স্মরণ করিয়ে দাও, এতে কাজ হবে, স্মরণ করাও… এর উপকার পাবে।

আপনি কাউকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, এতে কোন ফল পাওয়া গেল না । আপনি হয়ত বলবেন,”আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, সে পাত্তা দেয় নি হুহ! তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মাঝে কোন উপকার নেই। নবীজি (সাঃ) এর জীবনী দেখুন, তিনি কী পরিমাণ স্মরণ করিয়ে দিতেন? এবং আল্লাহ্‌ বলে যেতেন আপনি হয়ত উপকারিতা দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু সেখানে কি উপকারিতা আছে? হ্যাঁ আছে। এবং আন্তরিক ভাবে মনে করিয়ে দেয়া থেকে উপকারিতা প্রথম কে পাবে? সেই ব্যক্তি যে স্মরণ করিয়ে দেয়। কে প্রথমে উপকৃত হচ্ছে? আপনি, কারণ আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে শব্দ গুলো আপনার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে কিন্তু প্রভাব কোথা থেকে আসবে? আল্লাহ্‌র কাছ থেকে । যদি আপনার কথায় কাজ না হয় তাহলে হয়ত কার মাঝে কিছু সমস্যা আছে? আপনার। আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া এমন হওয়া উচিৎ নয় যে তার মাঝে কিছু সমস্যা আছে। সে আমার কথা শুনে না। এটি প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে না। আপনি জানেন ? নবীজি (সাঃ) (এবং এটি আমার শেষ মন্তব্য) যখন মানুষকে উপদেশ দিতেন, দাওয়াত দিতেন এবং তারা উনার (সাঃ) কথা শুনত না তখন উনার মনে চিন্তা উঁকি দিত-“হয়ত আমি আমার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছি না, হয়ত আমি এই কথাগুলো আরো ভাল ভাবে বলতে পারতাম । আর তখন আল্লাহ্‌ তাকে বলতেন ”, না না আপনি আপনার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছেন। আপনার যা করার কথা আপনি তাই করছেন। আপনি শুধু সতর্ক করে যান। আপনি শুধু সতর্ক করে যান। ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার যা করার কথা শুধু তা করে যান।আপনার যা করার কথা তা করে যান।

এই লাইন গুলোর সাথে, শেষ যে আয়াতটি আমার মাথায় এসেছে, আমার এটি আপনাদের সাথে শেয়ার করা উচিৎ কারণ এটি এই ইস্যুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইনশাল্লাহ। দুইটি আয়াত, একটি সুরা-শুরা, সুরা নাম্বার-৪২ এবং আরেকটি সূরা আলে ইমরানের আয়াত। যেখানে নবীজি (সাঃ) কে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারমানে দুইটি আয়াত। সুরা-শুরাঃ.وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُم ‘ ‘ তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরই তারা পারস্পরিক বিভেদের কারণে মতভেদ করেছে। (৪২;১৪) তারমানে কারা এখন মতপার্থক্য করছে? জ্ঞানী মানুষেরা। কিসে জ্ঞানী? বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান কিসে তারা জ্ঞানী? ধর্মীয় জ্ঞানে। কিতাবে জ্ঞানী, সুন্নাতে জ্ঞানী এবং জ্ঞানী হবার পর তারা কী করছে? মতবিরোধে পতিত হচ্ছে। কেন? আল্লাহ্‌ এর কারণ ও বলে দিয়েছেন,”بَغْيًا بَيْنَهُم” “একজন আরেকজনের উপর কর্তৃত্ব করার জিদ থেকে”। তাদের এরূপ জিদ থাকে এবং তারা নিজেদের সেরা মনে করতে চায় এবং কী সেই হাতিয়ার যা তাদের সেরা ভাবায়? ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান। তারা ধর্মীয় জ্ঞানকে এমন একটা মাধ্যম বানিয়ে ফেলে যা দ্বারা তারা নিজেদের গর্ববোধকে আরো বাড়িয়ে তোলে। সুবহানালাহ! কী ভয়ানক অপরাধ!

এবং এই আয়াতের শেষে আল্লাহ্‌ বলছেন —
وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِن رَّبِّكَ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى لَّقُضِيَ بَيْنَهُمْ
“যদি আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ফয়সালা হয়ে যেত।”

তাদেরকে তখনই শাস্তি প্রদান করা হত। এটি খুবই গুরতর অপরাধ। এটি খুবই গুরতর অপরাধ যে তারা তাদের দ্বীনকে মতবিরোধ এর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অহংকার ছাড়া অন্য কোন কিছুই তাদের জ্ঞানকে একে অপরের সাথে মতবিরোধ এর হাতিয়ারে পরিনত করেনি। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের এই মারাত্মক অপরাধ থেকে হিফাজত করুক বিশেষ করে আমাদের তরুন প্রজন্মকে। এই দেশে তরুণদের যে সংস্কৃতি, আপনারা “Ball” খেলেন; কেউ একজন আপনার শটকে ব্লক করে দেয়, এরপর কী হয়? পরের খেলায় আপনি প্রতিশোধ গ্রহন করেন এবং আপনার অবস্থান পুনরায় উদ্ধার করেন,কারণ প্রতিপক্ষ আপনাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে। এই হচ্ছে সংস্কৃতি, আমার বিরুদ্ধে তোমার এত সাহস কীভাবে হয়? এটি শুধু মাত্র কোন খেলা নয়, এটি অহংকারের একটি পরীক্ষা। গাড়ি চালানো অবস্হায় কেউ একজন আপনাকে পেছনে ফেলে যায়, কী আপনাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে? “তুমি! তুমি আমাকে তোমার Honda civic দিয়ে পাস করে যাচ্ছ? আমি আছি M5 এ…… না না আমি তোমাকে দেখে নিব। আমি তোমাকে আমার ক্ষমতা দেখায় ছাড়ব। আমি গ্যাস প্যাডেল ফ্লোর পর্যন্ত চাপ দিয়ে তোমাকে দেখায় দিব কীভাবে কী করতে হয়।” এসব কীসের বহিঃপ্রকাশ? অহংকার।

এই সমাজে প্রতিনিয়ত আমাদের জানানো হচ্ছে তোমার অহংকার বৃদ্ধি কর। সব কিছু তোমাকে নিয়ে। গীতিকার, সুরকাররা যে গান রচনা করে ..যেমন, আমার চেইন, আমার হ্যাট, আমার জুতা, আমার মোজা যাই হোক… সব কিছুতে আমি আমি আমি। তুমি আমাকে ছুঁতে পারবে না, আমার দিকে তাকাতে পারবে না, তুমি আমার চোখের দিকে তাকাবে না। আমি তোমার এই করব, এরপর আমি তোমার সেই করব। এসবের মানে কী? এসব কী তাৎপর্য বহন করে? অহংকার। নিজের উপাসনা করা। এটা ঠিক তাই। আসলেই এই ইগো আত্মপূজার দিকেই ধাবিত করে। এবং এই দ্বীন শুধু মাত্র তাদের জন্য একটি দ্বীন যারা আল্লাহ্‌র সামনে নিজেদেরকে নত করে দেয়। তারমানে এই আয়াতটি খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুরা আল-ইমরান এর ১৫৯ নং আয়াত।

বিশেষ করে আপনাদের মাঝে যারা নেতৃ স্থানীয় অবস্থানে আছেন, যাদেরকে অন্যরা অনুস্মরণ করে এবং যারা জানেন অথবা ভাবেন যে তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি জানেন। আল্লাহ্‌ তাঁর রসূল (সাঃ) কে বলেছেনঃ

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ

“আল্লাহ্‌র বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহের কারনে আপনি (সাঃ) সাহাবীদের প্রতি কোমল।” وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ যদি আপনি (সাঃ) তাদের প্রতি শক্ত হতেন, কঠোর হৃদয়ের হতেন, জিদ করতেন, এমনকি যদি তাদের সাথে কথা বলার সময় কিছু পরিমাণ কঠোরতা প্রদর্শন করতেন… لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ তারা আপনার থেকে দূরে সরে যেত।” তারা। তারা কারা? সাহাবারা। সাহাবারা আপনার থেকে দূরে পালিয়ে যেত এবং আপনি কে? রসূল(সাঃ)। চিন্তা করতে পারেন সাহাবারা রসূল(সাঃ) থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহ্‌ বলেননি, আপনি (সাঃ) যদি সত্যের পথে না ডাকেন তাহলে তারা পালিয়ে যাবে, আপনি যদি তাদের কোরআন শিক্ষা দেয়া বন্ধ করে দেন তাহলে তারা পালিয়ে যাবে, যদি আপনি ওহী প্রকাশ না করেন তাহলে তারা পালিয়ে যাবে…… রাসূল (সাঃ) কী করলে তারা পালিয়ে যাবে? তিনি এখনও কোরআন শিক্ষা দিচ্ছেন, এখনও সত্যের সন্ধান দিচ্ছেন, সবকিছুই আগের মত। শুধু মাত্র কী পরিবর্তনের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে যা তাদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে? তিনি(সাঃ) তাদের (সাহাবী) প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করলে, তাদের প্রতি কঠিন হলে.. এতোটুকুই যথেষ্ট এবং তারা দূরে সরে যাবে সুবহানাল্লাহ। কী দারণ শিক্ষা দিচ্ছেন আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূল (সাঃ) কে।

সর্বোৎকৃষ্ট নেতার প্রতি যদি এই শিক্ষা হয় তাহলে কি আপনার মনে হয় না এটি আমাদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? এটি অবশ্যই প্রযোজ্য। যদি আপনি কোন নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে থাকেন এবং যদি আমি হাত উঠাতে বলি, হাত উঠানোর দরকার নেই, কথার কথা- আমি যদি আমি হাত দেখাতে বলতাম, আপনারা কয়জন নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে আছেন? জানেন? আপনাদের প্রত্যেকের হাত উঠানো উচিৎ। আপনারা প্রত্যেকে নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে আছেন। আপনাদের সবার সে অবস্থান আছে যেখান থেকে আপনারা অন্য কাউকে উপদেশ দিতে পারেন এবং এটি খুবই ভালো কিন্তু আপনি কিভাবে উপদেশ দিবেন? বিশেষ করে যদি তারা মুসলিম হয়? তাদেরকে ধর্ম থেকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে আরো ধৈর্যশীল হতে শিখুন। আমি বলছি না- কেউ ভুল করলে তা মেনে নিতে হবে। আমি বলতে চাইছি যে, যদি হারাম কিছু করতে দেখেন তাহলে বলবেন- দেখুন আমি জানি এটি হারাম। আমি আপনার জন্য সত্যিই উদ্বিগ্ন। এটি বিভিন্ন ভাবে বলা যায়। এভাবে বুঝিয়ে বলা যায়।

এটা বলার বিভিন্ন ধরণ আছে, তাই না? “এই কাজটি করাতে তুমি দোজখে যাবে তুমি জানো তো?” ‒ এটা একভাবে বলা।”নিজের কাজের জন্য তোমার লজ্জিত হওয়া উচিৎ।” ‒ এটা বলার একটা ধরণ।”ভাই আমি সত্যিই তোমার জন্য উদ্বিগ্ন। তুমি জানো ওটা খারাপ আর আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি এটা কেন করছ? তোমার কোন সাহায্য লাগবে? আসলেই কেন করছ, বন্ধ কর। আসো এটা নিয়ে আলোচনা করি।” আন্তরিক! (অডিয়েন্সে বসা কেউ হাঁচি দিলেন, উস্তাদ নুমান বললেন, “ইয়ার হামু কাল্লাহ”, অর্থাৎ আল্লাহ আপনার প্রতি ক্ষমাশীল হোন)।

আন্তরিকতা, এটা দেখা যায় না, তবে প্রকাশিত হলে হৃদ্যতা বাড়ায়। আপনি কীভাবে মানুষের সাথে কথা বলেন, এতে প্রকাশ পায় আপনি আন্তরিক নাকি শুধু ওদের প্রতি আপনার মন্তব্য প্রকাশ করতে চান।

এখানে পার্থক্য আছে। আপনি মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলছেন এতে পার্থক্য আছে।أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ “আযিল্লাতিন আলাল মু’মিনীন”,(৫: ৫৪ ) বিশ্বাসীদের কাছে যখন নিজেদের উপস্থাপন করে ওরা আন্তরিক, বিনয়ী ‒ কুরআনে এভাবে বলা আছে, কিন্তু আপনি কীভাবে জানবেন আপনি আন্তরিক কিনা।

এই আয়াতে এটা বলা আছে, এরপরই আমরা শেষ করবো। فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
“ফা’ফু আনহুম ওয়াস তাঘফির লাহুম ওয়া শাভিরহুম্ ফিল আমার”,(৩: ১৫৯) তাদের ভুলের পর আপনি তাদের প্রতি সহনশীল; যদি তারা ভুল করে ফেলে, প্রথম কাজ, তাদেরকে মমতার সাথে ক্ষমা করে দিন।

“ফাফু আনহুম”, এরপর আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।

আল্লাহ্‌র কাছে অন্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা মানে এই নয় — ধরুন, কোন ভাই কিছু করলো আর আপনি বললেনঃ “এই, যা হোক আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তোমাকে মাফ করুন।”ওটা “ফাস্তাঘফির লাহুম” নয়। আপনি কখন তাদের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাইবেন?

যখন আপনি নিজের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাইছেন, নির্জনে ক্ষমা চাইছেন। নির্জনে প্রার্থনার মানে কী? ঐ প্রার্থনা আন্তরিক, ওটা অকৃত্রিম।

সবার সামনে যদি বলেন, “ভাই তুমি অনেক ভুলের মধ্যে আছ কিন্তু আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যেন তোমাকে মাফ করেন। আমি তোমার জন্য দোয়া করবো।” আয়াতে এটা বলা হয়নি। ওটা আসলে কীসের প্রকাশ? দম্ভ, অহং। তাদের জন্য আন্তরিকভাবে নির্জনে দোয়া করুন, “ফাস্তাঘফির লাহুম”।

আর ওরা যাতে বোঝে যে আপনি ওদেরকে ভদ্র মানুষ মনে করেন, “ওয়া শাভির হুম ফিল আমার”। তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তাদের মতামত গ্রহণ করুন। তাদের মতামত জানতে চান। তাদেরকে ভদ্র মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করুন। রাসুলাল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর কারো পরামর্শের প্রয়োজন ছিলো না। ওনার কাছে যা নাযিল হতো উনি তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতেন কিন্তু আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উনাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্যদের সাথে পরামর্শ করার আদেশ দিয়েছেন। কেন? যাতে তারা অনুভব করেন। কী? সংযুক্ত হতে পারার সম্মানবোধ। এটা একজন নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট, তাই নয় কি?

উনি তাঁর অধীনে যারা থাকেন তাদেরকে বুঝতে দেন যে তারাও সম্মানিত। وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। যখন আপনি কোন সিদ্ধান্ত নেন, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ওপর বিশ্বাস রাখুন । (৩:১৫৯) কারণ আপনার সিদ্ধান্তই সাফল্যের চাবিকাঠি নয়, সব সাফল্যের মূলে আছেন আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। “ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুতাওয়াক্কিলীন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর উপর নির্ভরকারীদের ভালবাসেন।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের তৌফিক দিন যেন আমরা তাঁর উপর আস্থা স্থাপন করি এবং যেন আমাদের অন্তরসমূহকে কঠিন না করে ফেলি। আমরা যেন পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ্‌র যিকর করতে পারি, আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে আমাদের চেয়েও ভালো মানুষের সঙ্গ দান করুন যেন আমরা আমাদের অহংবোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের এই তৌফিক দিন যেন আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষদের সদুপদেশ দিতে পারি।

যারা বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, যারা আমাদের সাথে এই চমৎকার কালেমায় বিশ্বাস করে তারা আমাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসার দাবি রাখেন। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আমাদেরকে রক্তের বন্ধন থেকেও বেশি কাছের করে দেয়। আমরা যেন অন্য সব মুসলিমদের জন্য সেই রকম ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং মানবিকতা অনুভব করি এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সেই আন্তরিকতা তাদের প্রতি প্রকাশ করতে পারি, আল্লাহ্‌ আমাদের সেই তৌফিক দিন। আমিন।

ভালো উপদেশ যাদের প্রয়োজন তাদের অন্তরে যেন তা প্রবেশ করে আল্লাহ সেই তৌফিক দান করুন। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের উপদেশ গ্রহণ করার ক্ষমতা দিন, আমরা যেন এর সবচেয়ে ভালোটুকু গ্রহণ করতে সমর্থ হই এবং উপদেশ যেন আমাদের অহংবোধ বাড়িয়ে তোলার কোন মাধ্যম হয়ে না ওঠে। আল্লাহ্‌ আমাদের বিনম্র রাখুন, আমাদের অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমা করে দিন। আমরা যেন প্রতিনিয়ত আমাদের অন্ত:করণ পরিশুদ্ধ করি আল্লাহ্‌ আমাদের সেই তৌফিক দিন। আমিন।

এবং পরিশেষে আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ্‌ যেন আমাদের অন্যান্য সব সম্মেলনের মতো এই সম্মেলনেও আমাদের সমস্ত ভালো কাজ, আমাদের সব ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে তাঁর কাছে করা সকল প্রার্থনা, এমনকি আমাদের ওজু, আমাদের নামায, আমাদের দোয়া আমাদের ভুলটুকু ছাড়া সব কবুল করে নেন। আল্লাহ্‌ যেন আমাদের সব কিছু কবুল করে নেন। আল্লাহ্‌ আমাদের সবার ভুলভ্রান্তি মাফ করে দিয়ে আমাদের সবার ইবাদত কবুল করে নিন। আমিন।

“রাব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আন্তাস সামি উল আলীম; ওয়া তুব আলাইনা ইয়া মা’উলানা ইন্নাকা আন্তা তাউওয়াবু রাহীম; ওয়া সাল্লালাহু তা’আলা আলা খাইরী খালক্বিহি ওয়া আলিহী ওয়া আসহাবিহী আসমাঈন”। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। শোনার জন্য যাযাকুমুল্লাহু খাইরান (ধন্যবাদ)।