কুরআন কি শেখায়, একতা নাকি বিভাজন?

কুরআন কি শেখায়, একতা নাকি বিভাজন?

উস্তাদ নুমান আলী খানের কুরআন উইকলি তে দেয়া কুরআনের রত্ন সিরিজ থেকে।

”আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার।” (আলে ইমরানঃ ১০৩)

আসসালামুয়ালাইকুম Quran Weekly. আজকে আমি আপনাদের কাছে খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত পরিবেশন করতে যাচ্ছি। এটি সূরা আল- ইমরান এর ১০৩ তম আয়াত। এটি থেকে কিছু শিক্ষা আমাদের জন্য, ইনশাল্লাহ যা আপনি এবং আমি উভয়ই হৃদয়ে ধারন করতে পারি, এবং এর আলোকে নিজেদের আলকিত করতে পারি।

আল্লাহ বলেনঃ ওয়াতাআসিমু বিহাব্লিল্লাহি জামিয়ান।ওয়াতাসিমু’ শব্দটি আরবিতে কোন কিছু নিরাপত্তার জন্য শক্ত করে ধরে রাখা বুঝায়। ‘ইস্মা’ হল নিরাপত্তা। ‘ইতসাম’ হল নিরাপত্তার জন্য কোন কিছু ধরে রাখা। নিজের নিরাপত্তার জন্য কোন কিছু আঁকড়ে ধরে থাকা। ‘ওয়াতাআসিমু বিহাব্লিল্লাহি’- আল্লাহ্‌র নিরাপত্তা অথবা আল্লাহ্‌র দড়ি ধরে থাকা। ‘জামিয়ান’- সবাই একসাথে, আল্লাহর দড়ি পরিপূর্ণ ভাবে ধরে থাকা।

দড়ি হল এমন কিছু যা আপনাকে সরাসরি অন্য কিছুর সাথে সংযুক্ত করে, ‘হাব্লুল্লাহ’- এই অংশটি- ‘হাব্লুল্লাহ’ – আল্লাহ্‌র দড়ি – এর ব্যাকরণগত গঠনও এটাই প্রকাশ করে যে এই দুটি শব্দ এখানে অবিচ্ছেদ্য। আরবিতে একে ‘ইদাফাহ’ বলা হয়। কিন্তু আমি ব্যাকরণের খুব গভীরে যাচ্ছি না। আমি যা বলতে চাচ্ছি, আল্লাহ এমন ভাবে বলছেন যেন এই দড়ি আল্লাহ্‌র সাথে সরাসরি সংযুক্ত, তাই আপনার নিরাপত্তার জন্য একে ধরে থাকা উচিৎ, এবং আপনি যদি তা করেন তাহলে আপনিও আল্লাহ্‌র সাথে সরাসরি যুক্ত হবেন, এবং আল্লাহ্‌র এই দড়ি, মহানবী (সাঃ) এর মতে হল- কুরআন নিজেই।

ওয়াতাআসিমু বিহাব্লিল্লাহি জামিয়ান- সবাই একসাথে। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের জন্য কুরআনের কাছে আসা একটি দলগত কাজ। আমাদের সবাইকে এটা একসাথে করতে হবে। কুরআনের কাছে আসার জন্য আপনাকে আমার সাহায্য করতে হবে, আবার আপনাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে। এটা এমন কিছু যা আমাদের সবাইকে একে অন্যের জন্য করতে হবে। এটা নিজে নিজে করার জন্য নয়। এর উপর “জামিয়ান” বা বলা যায়, তোমরা কুরআনের শুধু কিছু অংশ গ্রহন করে বাকি অংশ বাদ দিয়ো না। আপনাদের প্রচেষ্টা থাকতে হবে যথাসাধ্য সম্ভব কুরআনকে বুঝা এবং টা নিজের মধ্যে বাস্তবায়ন করার। এবং কুরআন থেকে যখন এমন কিছু আপনার সামনে আসবে, যা আপনি আগে জানতেন না, আপনার খুশি মনে একে গ্রহন করতে হবে।

স্পষ্টতই এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ যতক্ষণে আপনি এবং আমি পুরো কুরআন বুঝতে পারব, এটা আমাদের জীবনে সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু অন্তত এখন আমরা জানি আমাদেরকে কি উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে। আল্লাহ বলেনঃ ওয়ালা তাফাররাকু– যেন তোমরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে লিপ্ত না হও। এখানে মজার ব্যাপার হল, ইখতিলাফ বা মতবিরোধ শব্দটি একদিকে, কিন্তু এখানে যে শব্দটি এসেছে- ‘তাফাররাকু’ যার মানে হল নিজেদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা। তাফাররাকূ এর অর্থ বলতে আমি এটাই বলব। তারমানে আল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই এটা বলছেন যে তার বাণীর উপর অটল হতে এবং নিজেদের মধ্যে ভাঙন বন্ধ করতে। নিজেকে এই দল, অথবা অই দল, অথবা অন্য কোন দলের লোক বলে ভাবা বন্ধ করুন, এমন ভাবে নিজেকে অমুক দলের অন্তর্ভুক্ত করা যেন আপনি অন্য দলকে পথভ্রষ্ট বলতে পারেন আর নিজেকে ঠিক বলতে পারেন, অথবা বলতে পারেন এরা ভুল আর ওরা ঠিক। এটা বন্ধ করুন। আল্লাহ্‌র দড়ির কাছে আসুন, নিজেকে রক্ষার জন্য টা শক্ত করে ধরুন। নিজেদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না, যাই হোক, অনেকজন যখন একটি দড়ি ধরে থাকে তখন সত্যি সত্যি তারা নিজেদের কাছাকাছি চলে আসে। তাই আল্লাহ বলছেন, যখন আমরা কুরআন কে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসব, যখন আমরা এই পদক্ষেপ নিব, স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মধ্যে আর বেশি বেশি একতা বৃদ্ধি পাবে।

আমরা যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছি, আমরা বিভিন্ন ভাষা বলি, বর্তমানে ইংরেজি সাধারন ভাষা হিসেবে যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে, এবং মানুষ এখন এসব ভিডিও ইংরেজিতে দেখছে, তাইনা? কিন্তু আপনারা কি জানেন সত্যিকার সাধারন ভাষা কি? সত্যিকার অর্থে আপনি আমার কারনে এই ভিডিও দেখছেন না, দেখছেন কুরআনের কারনে, এটা হল আল্লাহ্‌র বানী। এবং আমি আশা করি যেন আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে একসাথে নিয়ে আসেন, কাছাকাছি নিয়ে আসেন, প্রতিটি মিনিট এবং সেকেন্ডে যা এমনকি যা আমরা কুরআন তিলাওয়াত শুনতে অতিবাহিত করি, অথবা এর ব্যাখ্যা শুনি। এটা কুরআনের একটি স্বাভাবিক পরিণতি যা নিজেদের মধ্যে ভাঙন বন্ধ করে। এমনকি আপনি ভাঙ্গনের চিন্তাও করবেন না। আপনি এটা চিন্তা করবেন না যে অন্য মুসলিম থেকে আপনি কোন দিক দিয়ে ভিন্ন, অথবা আপনি কিভাবে তাদের দোষ খুজে বের করবেন। আপনাকে আপনার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমাকে আমার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি যদি সর্বদা অন্য আলেম, অন্য দল, অন্য মতবাদ বা অন্য মুসলিমদের সমালোচনা করি, আর একই সাথে আমি ভাবছি যে আমি আল্লাহ্‌র কিতাব থেকেও শিখছি, তাহলে সম্ভবত তা সত্যি নয়। এই দুটি জিনিষ কখনও একসাথে চলতে পারেনা, আপনি আল্লাহ্‌র কিতাবের সাথে যতই যুক্ত হবেন, আপনার এই মনোভব আপনার কাছ থেকে ততই দূরে সরে যাবে।

তারপর আল্লাহ বলেনঃ ওয়ালা তাফাররাকু ওয়াজ কুরুনি আ’মাতা আল্লাহি আলাইকুম ইজ কুন্তুম আ’দা– দেখুন আল্লাহ কি বলছেন। তোমাদের উপর আল্লাহ্‌র নিয়ামত এর কথা স্মরণ কর যখন তোমরা শত্রু ছিলে। আমরা রামদানে এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি? যেমন ধরুন, আপনি রামাদানে মসজিদে আগের চেয়ে বেশি যান, সুবহানআল্লাহ, অথবা আপনি আগে জেতেন না, কিন্তু এখন যাচ্ছেন, আর এমন অনেক মুসলিম সেখানে আছে যারা আপনার থেকে ভিন্ন। যেমন আপনার হয়ত দাঁড়ি নেই তো আপনি দাড়িওয়ালা একজনকে দেখে ভাব্লেন, “এরা খুবই কট্টরপন্থী, উগ্র, এরা নিজেদের উঁচু মনে করে”। আপনি একজন মুসলিম বোন যিনি হিজাব পরেন না, আপনি রামাদানে মসজিদে ঢুকে আর অনেককে পর্দাশীল অবস্থায় দেখলে, আর আপনি পর্দা করেছেন কারন আপনি প্রথমবারের মত মসজিদে এসেছেন আর চিন্তা করছেন ‘এরা যদি জানত আমি আসলে কি রকম তাহলে আমাকে অন্যচোখে দেখত’। এবং একইভাবে আপনি যেমন অন্যদের প্রতি ভুল ধারণা পোষণ করেন তারাও আপনার প্রতি ভুল ধারণা রাখে। এটাই হল উত্তম সময় এই আয়াত এর শিক্ষাকে কাজে লাগানোর। তোমাদের উপর আল্লাহ্‌র নিয়ামত এর কথা স্মরণ কর যখন তোমরা শত্রু ছিলে।

কুন্তুম আদাফাল্লাহা বায়না কুলুবিকুম ফাসবাহতুম বিনি’মাতিহি ইখ্বানান– তিনিই সেই যিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা দিয়েছেন। লক্ষ্য করুন, এমনকি এই বাক্যের শেষে এটা বলাই যথেষ্ট ছিল যে তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা দেন এবং তোমাদের একে অপরের ভাইয়ে পরিনত করেন, কিন্তু তিনি আর জোর দিয়ে বলেছেন- ‘ফাসবাহতুম বিনি’মাতিহি ইখ্বানান’- বিশেষভাবে তার দয়া এবং শুধুমাত্র তার দয়ার কারনেই একে অপরের ভাইয়ে পরিনত হয়েছ। ইসবাহ তখনি ব্যবহার করা হয় যখন কোন কিছু পুরোপুরি রূপান্তর হয়ে যায়। ইসবাহ বলতে সকাল হওয়াও বুঝায়, যেন আপনি রাতে ছিলেন, আর আপনার জীবনে সকাল হল যখন আপনি আরেকজন মুসলিম এর সাথে ভ্রাতৃত্ব খুজে পেলেন। সুবহানআল্লাহ। আল্লাহ এটা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, তার নিয়ামতের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে আমরা অন্য মুসলিমদের প্রতি নম্রতা অনুভব করব।
এখন এমন একটা সময় যখন আমরা সবসময় সমালোচনায় লিপ্ত, মুভির সমালোচনা, গেমস এর সমালোচনা, আগের দিনের আলেমদের সমালোচনা, কিছু লোক এমনকি নবীদেরকেও ছেড়ে কথা বলেনা। কিছু লোক আছে যারা ধর্ম দূরে থাক, স্রষ্টাকেও সমালোচনা করতে ছাড়েনা। আমার আমাদের ধর্মের মধ্যেই কিছু লোক আছে যারা আগের যুগের আলেমদের সমালোচনা করে। তারা এমনকি বর্তমান সময়ের মানুষজনকেও ছাড় দেয় না। তারা অন্য মুসলিমদের, অন্য মতের, অন্য সংস্থার বা ছাত্রসংঘের সমালোচনা করে। তারা নিজেদের বন্ধুদের সমালোচনা করে অথবা স্থানীয় ইমামের। আমরা পুরোপুরিভাবে সমালোচনাতেই ডুবে আছি। আমরা এটাই করতে ভালোবাসি। তাহলে আল্লাহ্‌র নিয়ামত কোথায় যা আমাদের অন্যের প্রতি সদয় করে? এমনকি তারা যদি ভুলও হয়, তবুও আপনি তাদের কাছে যাবেন, তাদের কে জড়িয়ে ধরে বলবেন যে আপনি তাদের জন্য কতোটা ভাবেন, এবং তারপর সম্মানের সাথে তাদের ভুল শুধরানোর চেস্টা করবেন। এটা কোথায় গেল? রামাদানে এটাই আমাদের পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

ফাসবাহতুম বিনি’মাতিহি ইখ্বানান- তোমরা আবার ভাইয়ে পরিনত হলে। ওয়াকুন্তুম আলা শাফা হুফ্রাতিন্মিনারি ফাঙ্কাথাকুম মিনহা- তোমরা সবাই ছিলে আগুনের প্রান্তে, এবং তিনি তোমাদের তা থেকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ এখানে বলছেন যে- তোমাদের আগুন থেকে রক্ষা করা হয়েছে যেন তোমরা একে অন্যের ভাই হতে পার। এটা এমন যেন এই ভ্রাতৃত্ব দ্বারাই আল্লাহ আমাদের আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। এই ভ্রাতৃত্ব তোমাদের খারাপ কাজ থেকে দূরে রেখেছে, সুবহানআল্লাহ।

‘ওয়াকুন্তুম আলা শাফা হুফ্রাতিন্মিনারি ফাঙ্কাথাকুম মিনহা কাযালিকা উবায়্যিনু আল্লাহু লাকুম আয়াতিহি লাআল্লাকুম তাহতাদুন’– এভাবেই আল্লাহ তার অলৌকিক উদাহরণ তোমাদের সামনে তুলে ধরে, যেন তোমরা হেদায়েতের পথে চলতে পার। এখানে আল্লাহ বলছেন, আর এটাই হল শেষ কথা যা আমি আপনাদেরকে এই বার্তাতে বলতে চাচ্ছি- আল ইহতিদা- হেদায়েতের পথে প্রতিজ্ঞ থাকা, নিজের উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকা। নামাজ পরা, হাজ্জ করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, সত্য কথা বলা সবই এই নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে এমন কিছুই নেই যাকে আপনি এই নির্দেশনার অন্তর্গত বলতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ যখন একে বিশেষ ভাবে কোন আয়াতের শেষে রাখেন, এটা আয়াতের বক্তব্যের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। তাই এখানে বলা যায়, আল্লাহ বলছেন যে, আপনার ভাইয়ের প্রতি আপনার মনোভব, এবং ইসলামে ভাইয়ের প্রতি যে ভালোবাসার কথা বলা আছে তার কারন হল আল্লাহ আপনার মধ্যে যে ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছেন। তিনি এটা করেছেন যেন আপনারা তার নির্দেশনা মেনে চলতে পারেন। এবং এটা নিজেও এই নির্দেশনারই অংশ। আল্লাহ আমাদের জীবনের প্রতিটি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।