মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি এবং রাসুলের প্রতি দরূদ পেশ করছি।
আসলে দুটি আলাদা সমস্যায় দুই ধরনের উত্তর দেয়া হয়। প্রথম সমস্যা হল, কেউ বলছে আমি দিনে পাঁচ বার সালাত আদায় করতে পারি না। আমি এটা পারছি না। এখন, প্রথমত আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। যেই বলুক আমি এটা পারছি না, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। কেন জানেন? কারন আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি।
আর আমি বলিনি আমি আল্লাহকে স্বীকার করি, আমি বলেছি আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি। এর মধ্যে পার্থক্য আছে, তাই না? আমি আল্লাহকে স্বীকার করি মানে আমি আল্লাহের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন আমি বলি, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তার অর্থ আমি তার কথাগুলো বিশ্বাস করি। তিনি বলেন…আল্লাহ্ কখনোই কারও উপর সামর্থের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। এটাই আল্লাহ্ বলেছেন । তিনি বলেছেন তিনি কারও উপরে এমন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যতক্ষন না তারা সেই দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা অর্জন করে। আপনি বলছেন, আপনি এমন দায়িত্ব পালনে অক্ষম যা আল্লাহ্ আপনাকে দিয়েছেন। তাই নয় কি? আপনি বলছেন, আমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে পারছি না।
এটা মাত্রাতিরিক্ত! আর আল্লাহ্ বলছেন আপনি পারবেন। সুতরাং আমাকে বেছে নিতে হবে, আমি আপনাকে বিশ্বাস করব না আল্লাহকে। এবং সম্ভবত যদি আপনি তা বুঝতে না পারেন তাহলে নিজের সাথে মিথ্যাচার করছেন। সম্ভবত আপনি এমন ভাবছেন আপনার আলসেমীর কারনে, নিজের ইচ্ছার অভাবের কারনে, আপনি দিনে ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে চান না। আপনাকে পারতে হবে… আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না, আমি জানি না সমস্যাটা কি? কিংবা সমস্যাটা হল, আপনি অমুসলিমদের সামনে সালাত আদায়ে লজ্জা পাচ্ছেন। মানুষ কাজের ফাঁকে ১৫ মিনিট ধূমপানের বিরতি নিতে পারে, তাই না? তারা বিরতি নিয়ে বাইরে যেতে পারছে, যা খুশি করতে পারছে আর আপনি দিনে ৫ বার সালাত আদায় করতে পারছেন না? সুবহানাল্লাহ! পৃথিবীর এই প্রান্তে, আমি নিউ ইয়র্ক সিটিতে কাজ করি, আমি দেখি মুসলিমরা সব জায়গাতেই সালাত পড়ছে। রাস্তার মাঝে, ফুটপাতের উপরেও সে সালাত পড়ছে কারন তখন সালাতের সময়।
কিংবা আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর দরজা খুলেও দেখবেন সেখানে ৩জনে মিলে সালাত আদায় করছে। মুসলিমরা সালাত আদায় করে, সময় হলেই তারা সালাত পড়ে নেয়। এটাই প্রথম ব্যাপার, আল্লাহ্ বলেছেন আপনি সক্ষম। আর যদি তাই হয়, আল্লাহ্ আসলেই আপনাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, তাহলে আপনি পারবেন। সুতরাং নিজেকে বোঝান, আল্লাহর উপর ভরসা করেন, তিনি আপনার জন্য এটা সহজ করে দিবেন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, তিনি কি আসলে কিছু মনে করেন? আমার সালাত আদায় করা না করায় কি তার কিছু যায়-আসে?এখন এই প্রশ্নটা মূলতঃ, তাঁর কি আমার সালাতের কোন প্রয়োজন আছে? আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে সালাত আল্লাহর প্রয়োজনে নয়। এটা আপনার জন্য, আল্লাহর প্রয়োজনে নয়। যদি পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাদের জীবনভর সালাত পড়ে, এটা আল্লাহর সম্পদ বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি করে দিবে না।
এটা তার রাজ্যও বাড়িয়ে দিবে না কারন সমস্ত রাজত্বই তাঁর। আর কেউ যদি আর কখনো তাঁর নাম নাও নেয়, তাঁর রাজত্ব, রাজ্য বা মর্যাদার কোনরকম খর্বও হবে না। তাঁর আমাদের প্রয়োজন নেই, আমাদেরই তাকে দরকার, আমাদেরই তাকে দরকার। সুতরাং প্রশ্ন হল, আপনার কি মনে হয় আপনার প্রার্থনা করা দরকার? আপনার কি মনে হচ্ছে আপনার জীবনে এটা প্রয়োজনীয়? যদি না হয়, আপনার যদি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার, আল্লাহর দিকে যাওয়ার এবং তাঁর আদেশ মানার প্রয়োজন না পড়ে, তাহলে আপনার ঈমান মারাত্মক সংকটের মুখে।
তা দূর্বল হয়ে গিয়েছে এবং এই প্রশ্ন এই কারনেই দেখা দিয়েছে যে আপনি দীর্ঘদিন ধরে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরে আছেন এবং শয়তান আপনার কাছে আসতে পারছে আর বলছে…হ্যাঁ, আমি জানি, সালাত আদায় না করায় আপনার খারাপ লাগে, এই বাজে অনুভূতি দূর করে ফেলুন এবং একে প্রতিস্থাপন করুন এই অনুভূতি দিয়ে যে আপনার কেন সালাত আদায় আবশ্যক। এটা এই রোগের পরবর্তী পর্যায়। প্রথম অংশ হল, অন্তত এটা ধরা পড়ছে, আপনার কমপক্ষে খারাপ লাগছে, এখনো অপরাধবোধ কাজ করছে, এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পুরস্কার।
আর এই অপরাধবোধও যখন চলে যাবে, আপনি বলবেন আল্লাহর কাছে প্রার্থনার কোন দরকার নেই, সবই ঠিক আছে। যতদিন আমি ভালো কাজ করবো, এটাই আমার বক্তব্যের শেষ অংশ, এই “যতদিন আমি ভালো কাজ করবো” অংশ। কে ভালো-মন্দ ঠিক করে? এই পৃথিবীতে দুই ধরনের ভালো কাজ আছে। দয়া করে এটা মনে রাখবেন। দুই ধরনের ভালো কাজ আছে। একটি হচ্ছে নীতিশাস্ত্রের দিক থেকে ভালো। আমি আমার প্রতিবেশির কাছে ভালো, আমি আমার কাজে সৎ, আমি মানুষের নিকট ভালো, আমি চুরি করি না, আমি ধোঁকা দেই না। এগুলো হচ্ছে মূলনীতি।
আমি সত্য বলি, আমি সৎ, আমি ট্যাক্স দেই… এগুলো হচ্ছে নীতিগত সত্য। এবং আমি ব্যাবসায় সৎ। এছাড়াও আছে ধর্মীয় ব্যাপার। আমি হজ্বে যাই, আমি যাকাত দেই, আমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, আমি রমযানে সাওম পালন করি। এগুলো নীতিগত বাস্তবতা নয়, এগুলো হচ্ছে ধর্ম অনুযায়ী ভালো কাজ। ভালো কাজ যা ধর্মীয় এবং ভালো কাজ যা নীতিশাস্ত্রীয়, স্বাভাবিকভাবেই নৈতিক। এটা অসংখ্যবার মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের সাথেই ঘটে, বিশেষ করে মুসলিমদের সাথে। আমরা এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করে ফেলি। তাই, মুসলিম বিশ্বে আপনি দেখবেন যে মানুষ নৈতিক দিক দিয়ে ভালো।তারা পরিবারের প্রতি যত্নশীল, বাচ্চাদের যত্ন নিচ্ছে, গৃহস্থালী কাজে দায়িত্বশীল, প্রতিবেশীর প্রতি সচেতন, কাজের প্রতি সৎ। ভালো মানুষ, কিন্তু ধার্মিক না। আমার ভালো হতে ধর্মের প্রয়োজন নেই, তারা বলবে। আর অন্যদিকে আপনি কিছু মানুষ পাবেন যারা সালাত আদায় করে, হজ্বে যায়, যাকাত দেয়, লম্বা দাড়ি রাখে, ধর্মীয় পোষাক পরিচ্ছদ পরে। এবং তবুও পরিবারের প্রতি ভয়ংকর, ব্যাবসায় প্রতারণা করে, নীতিগত দিক দিয়ে খুবই খারাপ।
তাহলে আমরা ভালোর দুটি বিভাগ তৈরি করলে কি ঘটবে? নৈতিক দিক দিয়ে ভালো, শাস্ত্র অনুযায়ী ভালো এবং ধর্মীয় দিক থেকে ভালো। আল্লাহ্ কুরআনে যা করলেন তা হল এই দুটিকে একত্রে বেঁধে দিলেন। একটি আয়াত দিয়ে যাকে বলে আয়াতুল বির- উত্তমের আয়াত, এতে উত্তমের সংজ্ঞা কিভাবে দিয়েছে? আপনি এই আয়াত পড়লে দেখবেন এতে দুটি জিনিস বলা হয়েছে। এতে নীতিশাস্ত্র, তোমার ওয়াদা রাখ, ধৈর্যশীল হও, উদ্যমী হও এর সাথে ধর্মীয় গুনাবলী সালাত কায়েম করা, যাকাত দেয়ার সমন্বয় ঘটেছে।
তাই এটা এক জায়গায় এই উভয়ের সমন্বয় করেছে। তাই আপনি যদি ভাবেন আপনি ভালোকে সংজ্ঞায়িত করবেন, তাহলে আপনি বোধহয় নৈতিক গুনাবলীর কথা বলছেন। এবং আপনি ধর্মীয় গুনাবলীর কথা ভুলে গেছেন। যে আচার গুলো আল্লাহ্ আমাদের শিখিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ্ চান আমরা একই সাথে দুটোই অর্জন করি। আর তখনই একজন প্রকৃত অর্থেই ভালো হবেন। তা না হলে আপনি প্রকৃত অর্থে ভালো নয়। আপনি আপনার মতো করে ভালোকে সংজ্ঞায়িত করছেন। আর আল্লাহর সংজ্ঞাকে বাতিল করে দিচ্ছেন! কিন্তু আমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করি কারন আমরা আমাদের মতো করে জিনিসগুলোর সংজ্ঞা দিতে পারি না। এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন। ইনশাআল্লাহ তায়ালা (আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করেন)।
আয়াতুল বির এর বাংলা অনুবাদঃ
”সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।”
[সূরা বাকারাঃ ১৭৭]