ফিরাউনের শাসন প্রণালী ও আজকের বিশ্ব

ফিরাউনের শাসন প্রণালী ও আজকের বিশ্ব

উস্তাদ নুমান আলী খানের “Speak up, Make a Difference” লেকচারের অংশ বিশেষ।

 

আজকের খুতবায় আমি একটি উচ্চ লক্ষ্য স্থির করেছি। আমি সচরাচর এমনটা করিনা। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি এটা করাকে আবশ্যক মনে করছি।

আমি শুরুর আগে আপনাদের কিছু পূর্ব ধারণা দিতে চাই। আল্লাহ আযযাওয়াজাল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় মুসা (আঃ) এবং তাঁর সংগ্রাম নিয়ে কথা বলেছেন। এবং মুসা (আঃ) এর কাহিনীতে অন্যতম একজন, যাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তিনি হলেন মুসা (আঃ) এর একজন বন্ধু। এই বন্ধুটি তৎকালীন মিশরীয় সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি ফিরাউনের অধীনে ছিলেন। তাকে আপনারা একজন সেনা প্রধান অথবা পুলিশ প্রধান হিসেবে ভাবতে পারেন। যেহেতু সেটা ছিল একটি পুলিশি রাষ্ট্র। এবং মুসা (আঃ) এর সাথে বন্ধুত্বের কারণে তিনি মুসলিমও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এটা কাউকে বলেননি। তিনি চুপিচুপি মুসলিম ছিলেন। এবং এই ব্যক্তিই হল সেই ব্যক্তি যিনি মুসা (আঃ) কে মিশর থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন।

সূরা গাফিরে আল্লাহ আমাদের এই ব্যক্তি সম্পর্কে বলছেন, আমাদের সময়ে তাফসিরে তাকে যে নামে ডাকা হয়, যেহেতু তার নাম উল্লেখ করা নেই, তা হল “মু’মিনু আলি ফিরাউন”, ফিরাউনের সম্প্রদায়ের বিশ্বাসী। ফিরাউনের অধীনস্থ বিশ্বাসী। কিছু একটা ঘটল মুসা (আঃ) এর জীবনে, এমন কিছু যা আগে কখনও ঘটেনি এবং তা এক সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। আর আমি আজকে এই চূড়ান্ত পর্যায়টি নিয়েই আলোচনা করতে যাচ্ছি।

নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাবান কারও যদি মুসা (আঃ) এর প্রতি সামান্য সহানুভূতি থেকে থাকে তবে সে হল ফিরাউন নিজেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মুসা (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন,

“ওয়া আল্কাইতু আলাইকা মহাব্বাতান মিন্নি” (সূরা তাহাঃ ৩৯)।
“আমি তোমার প্রতি এক বিশেষ ভালোবাসা প্রদান করেছি, যা শুধু আমার পক্ষ থেকে।”

এই ভালবাসার একটি নিদর্শন হলঃ যখন ফিরাউন তাঁকে প্রথমবার দেখেছিল সে তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যদিও শিশুটি ছিল বানী ইসরায়েলের, সে ছিল দাস জাতির একজন। তাঁর গায়ের রঙ দেখেই বুঝা যায় যে, সে তাদের শ্রেণীর নয়। এরপরেও সে তাকে ভালবেসেছিল, এবং তাকে রাজপুত্রের মত বড় করা হয়েছিল। ফিরাউনের অধীনে, ফিরাউনের নিজ হাতে। তাই এমনকি যখন মুসা (আঃ) ফিরে আসলেন এবং ফিরাউনের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, এবং তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হল, কিন্তু মুসা (আঃ )এর প্রতি তার যে ভালোবাসা ছিল, তার কারণে সে তাকে হত্যা করল না। একে আপানারা ভালভাবেই জানেন। সে মানুষ হত্যা করার ব্যাপারে কোন রকম দ্বিধাবোধ করতো না। আমরা জানি যে সে প্রতি ১ বছর পর অসংখ্য শিশুদের হত্যা করতো। তার অন্তরে হত্যা করার ব্যাপারে কোনরূপ দ্বিধানুভূতি ছিলনা।

স্বাভাবিকভাবেই যখন কেউ তার দরবারে প্রবেশ করে তার বিরোধিতা করবে, এর একমাত্র প্রতিকার হল তাকে হত্যা করা। কিন্তু মুসা (আঃ) বারবার ছাড় পেয়ে আসছিলেন। এর কারণটি কুরআনে যথাযথ ভাবে বলা আছে, তার অন্তরে একটি দুর্বলতা ছিল মুসা (আঃ) এর প্রতি, যা সে দূর করতে পারেনি। এই বিষয়ে বলা যায়, এটি একটি সাইড নোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আযযাওয়াজাল হৃদয় নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি ফিরাউনের হৃদয়ও। এমন কিছু আল্লাহ তার হৃদয়েও দিয়ে দেন, যা থেকে সে নিজেও বাঁচতে পারেনি। এমনকি সেও অস্বীকার করতে পারেনি। তাই আল্লাহ তার সকল সৃষ্টিকে তার অধিনস্ত রেখেছেন, এমনকি আল্লাহ্‌র শত্রুরাও আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যখন আল্লাহ চান। কোন কিছুই আল্লাহ্‌র ক্ষমতা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারেনা, কোন কিছুই না। এমনকি ফিরাউনও না। এমনকি তার মত ক্ষমতাধর হয়েও না।

যাই হোক, সে মুসা (আঃ) কে কিছুটা ছাড় দিচ্ছিল যার কারণে মুসা (আঃ) তার কাজ করে যেতে পারছিলেন। ইসলাম প্রচার করা। শুধু ফিরাউনের লোকজনকে নয়, বনী ইসরায়েলের লোকজনকেও বানী পৌঁছে দেয়া। আর এটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। কারণ ফিরাউনের সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এমন কখনও হয়নি যে, কেউ তার বিরুদ্ধাচারন করেছে, এবং তার থেকে বেঁচে এসে অন্যদের তা বলতে পেরেছে। এমনটা আগে ঘটেনি। আর এই ব্যাক্তি, মুসা (আঃ) একটি শোরগোল তৈরি করে ফেললেন। তিনি সবার কাছে গিয়ে গিয়ে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে ডাকছেন। এটা শুধু ধর্মগত নয়, আপনাদের বুঝতে হবে, এটা একটি রাজনৈতিক প্রচারনাও। কারণ ফিরাউন নিজেকে খোদা দাবি করতো। এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তির উৎসও ছিল তার নিজেকে খোদা দাবি করা। আপনি তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না, কারণ তার রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারন করার মানে খোদার বিরুদ্ধাচারন করা। সে তার লোকজনের সাথে এই রাজনৈতিক খেলাটিই খেলেছিল।

আর তাই এখন মুসা (আঃ) যখন মানুষকে “আল ইলাহ” আল্লাহ আযযাওাজাল এর দিকে ডাকছে, “রাব্বুকুম ওয়া রাব্বু আবাইকুম, ওয়াল আওয়ালিন” তিনি তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃ-পুরুষদেরও পালনকর্তা।। তিনি যখন তা করছেন, তখন তিনি সেই সমাজের রাজনৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা সমস্যাজনক। আর যদিও ফিরাউন তা সহ্য করছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে, সে যদি এটা আরও সহ্য করে তবে তার সরকার ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই চূড়ান্ত পর্যায়টির আবির্ভাব হল। আর যখন এই পর্যায়টি আসলো, তখন ফিরাউন এমন এক পরিকল্পনা করলো যা ইতিহাসে জঘন্যতম।

শুনুন তাহলে,

“ فَلَمَّا جَاءَهُم بِالْحَقِّ مِنْ عِندِنَا قَالُوا اقْتُلُوا أَبْنَاءَ الَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ وَاسْتَحْيُوا نِسَاءَهُمْ”-
” অতঃপর মূসা যখন আমার কাছ থেকে সত্যসহ তাদের কাছে পৌঁছাল; তখন তারা বলল, যারা তার সঙ্গী হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা কর, আর তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ।” (সূরা গাফির:২৫)

আমরা আগেই জানি যে, সে প্রতি ১ বছর পর পর ছেলে শিশুদের মেরে ফেলত, কিন্তু নারীদের বেঁচে থাকতে দিত। এটা ইতিহাসের আরেকটা অংশ। কিন্তু যখন ব্যাপারটা চূড়ান্ত হল, তখন সে নতুন বুদ্ধি বের করলো। আর নতুন বুদ্ধিটি হল, যারা মুসা (আঃ)কে বিশ্বাস করেছে, কারণ মুসা (আঃ) দাওয়া দিচ্ছিলেন, প্রত্যেক পরিবার যারা মুসা (আঃ) কে বিশ্বাস করেছে, তারা রাষ্ট্রের শত্রু, আমাদের তাদেরকে হুমকি দিতে হবে, তাদেরকে মেরো না, তাদের সন্তানদের মেরে ফেল। তাদেরকে মারবেনা, রাষ্ট্রের শত্রুদের মারবেনা, যারা মুসা (আঃ) কে বিশ্বাস করেছে তাদেরকে মারবেনা, তাদের সন্তানদের মেরে ফেল।

এটা ছিল সবচেয়ে কুৎসিত সামরিক অভিযান, সবচেয়ে খারাপ শয়তানি বুদ্ধি যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ব্যবহার করা হয়েছে। যে, শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, শত্রুকে না মেরে তাদের সন্তানদের হত্যা করা। আর আজকে মুসলিম বিশ্বে, পাকিস্তানে, মানুষ শুধু তার শত্রুর প্রতি ঘৃণার কারণে, তাদের সন্তানদের হত্যা করছে। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করছে। এসব লোক আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ)এর সুন্নাহ পালন করছেনা, আমি যখন খবরটি শুনেছিলাম তখন আমি গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিছুক্ষণ বসে বসে কেঁদেছিলাম, গাড়ি চালাতে পারছিলাম না। এরা আমাদেরই শিশু, আমাদেরই সন্তান। তারা খুন হয়েছে এমন মানুষের দ্বারা যারা বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”!

আমি কোনভাবেই এটা বুঝতে পারিনা। এমনকি আমি এব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়া বা খবরের আপডেট নিতেও যাইনা। কেউ আমাকে একটি ছবি পাঠিয়েছে, যেটাতে এসব লোকদের একজন, যে এটাকে ন্যায়সঙ্গত বলে দেখাতে চাইছে, এবং সে বুখারি থেকে হাদিস উল্লেখ করছে, এসব লোকদের রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নাম নেয়ারও অধিকার নেই। এরা যদি কোন সুন্নাহ মেনে থাকে তবে তা হল ফিরাউনের সুন্নাহ। এটাই একমাত্র সুন্নাহ যা তারা মেনে চলছে। শত্রুর সন্তানদের মেরে ফেল। তারা এটাই করছে। এটা তারই বুদ্ধি ছিল, শিশুদের মেরে ফেল, নারীদের বাঁচিয়ে রাখ।