Quran Weekly তে দেয়া উস্তাদ নুমান আলী খানের Quranic Gems সিরিজ থেকে।
আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
আজকে আমি আপনাদের সাথে সূরা বাকারার ৫৭তম আয়াতের কিছু বিষয় বর্ণনা করতে চাই। এবং এই আয়াত আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল বনী ইসরাইলদের সম্বোধন করে বলছেন, ইসরাইলের সন্তানদের। এবং আল্লাহ্ তার কিছু অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। যেই কারণে আমি আপনাদের সাথে আয়াতটি শেয়ার করতে চাই তা হল এই আয়াতটির ভেতরে একটি অসাধারণ স্থানান্তরণ ঘটে। সেই পরিবৃত্তি অনুধাবন করার সুবিধার্থে আমি প্রথমে আপনাদের জন্য একটি দৃশ্যপট দাঁড় করছি।
ধরুন একজন শিক্ষক ক্লাসরুমে, এবং ধরা যাক তার ছাত্ররা ৩ ভাগে, না, ২ ভাগে বিভক্ত। বাম পাশে হচ্ছে ছাত্রদের একাংশ, মাঝখানে কিছুটা ফাঁক, এবং ডান পাশে রয়েছে আরেক অংশ। বাম পার্শ্ববর্তী ছাত্ররা আগের দিন পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে, ধরা যাক তারা গ্রুপ A, তারা পরীক্ষা দিয়েছে, এবং ফেল করেছে। আর গ্রুপ B এই পরীক্ষাটি দিবে কালকে। দিনটি হল দুই পরীক্ষার মধ্যখানে। শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলেন, এবং গ্রুপ A, যারা কিনা পরীক্ষাটি দিয়েছে, তাদেরকে তীব্র ভাবে বকা দিতে লাগলেন। কারণ তারা পাশ করে নি। এবং তিনি বকা দিয়ে বলছেন, মনে করেন, “ আমি তোমাদের জন্য কি না করেছি!রিভিউ করেছি!সব উত্তর দিয়ে দিয়েছিলাম, এমন কি প্রশ্নপত্রের কপিও পরীক্ষার আগের দিন দিয়ে দিয়েছিলাম!তাও কিভাবে ফেল করলে? তোমাদের জন্য আর বেশি কি করা যাই আমি ভেবে পাই না!” আর এই সময়টুকুতে, যখন তিনি তাদেরকে বকাঝকা করছিলেন, গ্রুপ B বসে বসে দেখছিল।
কয়েকজন ওই ছাত্রগুলোকে টিটকারি মারছিল, “হা হা দেখ না ওদের অবস্থা”। তবে তাদের মধ্যেকার অন্যরা,যারা বুদ্ধিমান, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল কারণ তারা জানে কাল তাদের পরীক্ষা, এবং তারা খুব শীঘ্রই একি ধরনের শাস্তির শিকার হতে পারে। এখন শিক্ষক বললেন, “তোমরা, জান? তোমাদের সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না”। তিনি গ্রুপ A কে পাত্তা দিলেন না যেন কি না উনি তাদের উপর প্রবল ভাবে রাগান্বিত যে তারা কোন প্রকার সম্বোধনের যোগ্যতা রাখে না। তারপর তিনি গ্রুপ B’র দিকে ফেরেন। এবং বলেন, ‘তোমাদের পরীক্ষা কিন্তু আগামীকাল। আর মনে রেখ, তারা কিন্তু আমায় ব্যর্থ করে নি। নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থ করেছে। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে তা বলেন। এখন আমি চাই আপনারা এই দৃশ্যপটটি মনে রাখুন আমি এই আয়াতটির কিছু বর্ণনা করতে করতে। বোঝার সুবিধার্থে।
আল্লাহ্ কাকে সম্বোধন করছেন মনে আছে তো? ইসরাইলের সন্তানদের। আল্লাহ্ বলেন وَظَلَّلْنَاعَلَيْكُمُ الْغَمَامَ । আমরা তোমাদের ছায়া দান করলাম, তোমাদের ছায়াময় করলাম বৃষ্টিতে ভরপুর মেঘালয় দ্বারা। এই বৃষ্টিপাতের মেঘগুলো বা নরম মেঘগুলো, غَمَامْ (ghamam) বলা যায়, বা আরও বলা যায় ঘোর মেঘগুলো যা সূর্যরশ্মি ঠেকাতে পারে। তারা রয়েছে মরুভূমিতে, তাই আল্লাহ্ কুদরতি ভাবে আকাশ থেকে একটি ছাতা দিয়ে তাদের আচ্ছাদিত করে দেন। জানো, মেঘমালা তাদের অনুসরণ করত। এক নম্বর পয়েন্ট।
وَأَنزَلْنَاعَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّاوَى এবং আমরা তোমাদের নিকট মান্না ও সাল্ওয়া প্রেরণ করলাম। মান্না ও সাল্ওয়া হোল এক জাতীয় গম যা তারা মরুভূমির মাঝেই উৎপাদন করতে পারতো, আল্লাহ্ তাদের নিকট শস্য পাঠাতেন যাতে করে তারা জীবিকা বানাতে পারে। আর সাল্ওয়া হোল এক ধরনের পাখি যা তারা ধরার চেষ্টা করত, এবং তা উড়ে চলে যেতো না। কুদরতি ভাবে তাদের প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট এর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। হয়ে গেছে তাদের ছায়ার ব্যবস্থা। অবশেষে আল্লাহ্ তাদের পানির ঝরনা দিবেন। সেই বারো ঝরনাসমূহ যেগুলোর ব্যাপারে আপনারা অবগত। তো তাদের পানির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারা বেঁচে রয়েছে অসম্ভব ঘটনাবলির মাঝে, এবং এটি হচ্ছে অনুগ্রহের তালিকা। আমি তোমাদের জন্য এটা করেছি…আমি তোমাদের জন্য এটা করেছি…আমি তোমাদের জন্য এটা করেছি… . وَأَنزَلْنَاعَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّاوَى ।
তারপর আল্লাহ্ বলেন, كُلُوامِن طَيِّبَتِ مَارَزَقْنَكُمْ । খাও, ব্যবহার করো ভালো জিনিসগুলো থেকে, (ব্যবহার করো) তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহের পবিত্র বস্তুসমূহ থেকে। আমার প্রেরিত নেয়ামত থেকে যা তোমাদেরকে দিয়েছি। তারপর, এগুলো সব, লক্ষ্য করলে দেখবেন, ছিল ‘তুমি’র মধ্যে। মানে ظَلَّلْنَاعَلَيْكُمُ । আমরা ‘তোমাদের’ ছায়া দান করলাম। আমরা ‘তোমাদের’ উপর মেঘমালা দিলাম। ‘তোমাদের’ প্রতি প্রেরণ করলাম মান্না এবং সাল্ওয়া। আহার করো, যখন আপনি কাউকে কোন আদেশ দেন, আমার দাওয়া ভাল জিনিস থেকে খাও। জানেন, পুরো ব্যাপারটা, ‘তুমি’ শব্দটি মধ্যম পুরুষের (বাংলা ব্যাকরণ) এখানে ইঙ্গিত দেয় । এর পেছনের যুক্তি হল যে আপনি কারও সাথে কথা বলছেন। কিন্তু এখন খেয়াল করুন একই আয়াতের শেষাংশ وَمَاظَلَمُونَاوَلَكِن كَانُواأَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ আরবিতে যা হবার কথা তার বিপরীত ঘটে وَمَاظَلَمْتُمُونَا وَلَكِنتُمْ كَانُو اأَنفُسَكُمْ تَظْلِمُونَ তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি নিজেরাই জুলুম করছিলে। না, আল্লাহ্ তা বলেন না। আল্লাহ্ বলেন, তারা আমার প্রতি জুলুম করে নি, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করছিল। অন্য কথায়, অর্ধেক আয়াতই ‘তুমি’ তে, অর্থাৎ মধ্যম পুরুষে , বাকি অর্ধেক আয়াত হল উত্তম পুরুষে , যেন কি না তারা সেখানে নেই। আর যদি তারা থাকেও, ব্যাপারটির মূল হচ্ছে যে, আল্লাহ্ তাদের সম্বোধন করবেন না।
এখন চিন্তা করুন শিক্ষকটির ব্যাপারে। টিচার এক গ্রুপকে বকাঝকা করেন। তিনি এতো হতাশ যে, সেই ছাত্ররা এখন আর গণনার মধ্যে পরে না। তিনি আর তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নন। তাই তিনি ঘুরে তাকান, ফিরেন আরেক গ্রুপের দিকে, এবং বলেন, “মনে রেখ, তারা কিন্তু আমায় নিরাশ করে নি”। এখন আয়াতটি বলে, وَمَاظَلَمُونَا তারা আমার প্রতি জুলুম করে নি। তারা শুধু নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে।
তো, এই পরিবর্তনের কারণ টা কি? কারণটি হচ্ছে আমরা ইহুদীদের ব্যাপারে আয়াতটি পড়ি না, এবং পূর্বেকার জাতিদের। বিশেষ করে ইহুদীদের ব্যাপারে, আমি দাবী করতে পারি। আমরা কিন্তু তাদের ব্যাপারে আয়াত পরে বলি না, ‘দেখ আল্লাহ্ ইহুদীদের ব্যাপারে কি বলছেন। হা হা! আল্লাহ্ তাদেরকে ভাল ভাবে পাকড়াও করেছেন। দেখ না আল্লাহ্ তাদের জন্য কত কিছু করেছেন!’ তবে আয়াতটি তাদের (ইহুদীদের) ব্যাপারে ছিল না। আয়াতটি তাদের ব্যাপারে ছিল, তবে বাকি অর্ধেক এরকম যে, ‘এই! এরপর তোমার পালা, প্রস্তুত হও!’ আর সাবধান থেক যেন তোমরা নিজেরা এমন ভুল না করে বস।
এটি অবিশ্বাস্য, যে বনী ইসরাইল এর এই আয়াতটির ভেতরে দিয়ে, আমি জানি আপনারা হয়ত এটি আগেও শুনেছেন কোন লেকচারে, এবং আমাদের জানা উচিৎ পূর্বেকার জাতিদের ব্যাপারে যাতে করে আমরা তাদের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না করি। আসলে, এটি আমাদের উপলব্ধিকৃত বিশ্লেষণ নয়। ব্যাপারটি কুরআনেই দৃঢ়ভাবে নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করা ছাড়া কোন বারও ইহুদীদের ইতিহাস শুনাননি, যেন আমরা ওদের মত নিজেরা গর্তে না পরি। ইহুদীদের ইতিহাস পড়ে আমাদের যদি এই রকম অনুভূতি আসে যে ‘আমরা তাদের থেকে ভাল’ তাহলে তা ভুল বুঝা হবে। আর যদি আমরা বিনম্রতা শিখি তাহলে তা সঠিক বুঝ হবে। যেমন মনে করেন, ‘ইয়া আল্লাহ্, আমরা একেবারে তাদের মতো একই পর্যায়ে রয়েছি, এবং আপনাকে নিরাশ করা আমাদের একেবারেই উচিৎ হবে না’। কারণ এই একই সমালোচনা যা তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে আমাদের উপর ১০০ ভাগ প্রযোজ্য।
দোয়া করি আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল যেন আমাদের সেসব ব্যক্তিদের অন্তরভুক্ত করেন যারা বোঝে এবং উপলব্ধি করে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের শেখাচ্ছেন। وَيُعَلِّمُكُمُ اللّهُ وَاللّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ । আল্লাহ্ তোমায় শেখাচ্ছেন, এবং আল্লাহ্ সকল জ্ঞানের অধিকারী। আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে এই কিতাবের যথোচিত ছাত্র বানিয়ে দেন।
বারাক আল্লাহু ওয়ালি ওয়ালাকুম । ওয়াসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।