ঈমান, লেভেল ও আমাদের জাজমেন্টাল মানসিকতা – ১ম পর্ব

ঈমান, লেভেল ও আমাদের জাজমেন্টাল মানসিকতা – ১ম পর্ব

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আমরা যখন ঈমানের কথা চিন্তা করি তখন প্রথমত দুই প্রকার ঈমানের কথা বলি। সেগুলো হলো

 

১। আইনগত ঈমান (Legal Iman)

২। প্রকৃত ঈমান (Real Iman)

 

প্রকৃত ঈমান দুই প্রকার

 

১। আধ্যাত্বিক ঈমান (Sprititual Iman)

২। বুদ্ধিবৃত্তিক/যৌক্তিক ঈমান (Intellectual/ Rational Iman)

 

কেউ যখন শাহাদাহ বলে ইসলাম গ্রহণ করে, সেটা লিগাল বা আইনগত ঈমান। অর্থাৎ তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলামী আইনগতভাবে বা শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সে মুসলিম। লিগাল ঈমানের সুবিধা হলো একজন ব্যক্তি যে মুসলিম সেটা বুঝতে পারি। তার ঈমানে অবস্থা কি, কিয়ামাতের দিনে সে কেমন থাকবে এসব বিষয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। লিগাল ঈমান আখিরাতে কোনো কাজে আসবে না। আখিরাতে একমাত্র প্রকৃত ঈমান-ই কাজে আসবে। আপনি সালাত আদায় করেন, আমরা আপনাকে সালাম দেই, আপনি দুনিয়াতে ইসলাম গ্রহণ করে সন্তুষ্ট। আপনি দুনিয়াতে সবার কাছে মুসলিম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আখিরাতে আল্লাহর কাছে ধর্তব্য বিষয় হবে একমাত্র প্রকৃত ঈমান।

লিগাল ঈমান স্থির। এটা কমেও না বাড়েও না। আপনি ঘুমালেও মুসলিম, জেগে থাকলেও মুসলিম, সালাত আদায় করলেও মুসলিম। আল্লাহ যখন ‘হে ইমানদারগণ’ বলে সম্বোধন করেন, এটা ইসলাম যে গ্রহণ করেছে সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করে।

কিন্তু আমরা তো এও জানি আমাদের ঈমানের কিছু বিষয়াবলি কমে-বাড়ে, ওঠানামা করে এটাই প্রকৃত ঈমান। অর্থাৎ প্রকৃত ঈমান কমে বাড়ে আমাদের ভালো-মন্দ, পূণ্য বা পাপ কাজ করার কারণে। আর এই প্রকৃত ঈমানের মধ্যে ‘আধ্যাত্বিক ঈমান’-ই ওঠানামা করে বা কমে-বাড়ে। এই ‘আধ্যাত্বিক ঈমান’ যখন অতিরিক্ত ওঠানামা করে তখন এটি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ঈমান’ এর সাথে বিশৃংখলা ঘটায়, তালগোল পাকিয়ে ফেলে এভাবেই ঈমানের বিষয়গুলো কাজ করে। আপনি লিগালি মুসলিম কিন্তু আপনার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক, মানুষে সাথে সম্পর্কে প্রকৃত ঈমান ওঠানামা করে, যা আল্লাহর নিকটে আখিরাতে মূল হিসেবে গণ্য হবে, যার ভিত্তিতে আল্লাহ হিসাব নির্ধারণ করবেন।

কুরআনের প্রাথমিক নির্দেশনা এই প্রকৃত ঈমান নিয়েই, যাকে আমরা কখনই জাজ(রায় বা মতামত দেওয়া) করি না। এখানেই আমাদের প্রকৃত বিষয়ে গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা দুনিয়াতে কাউকে কিসের ভিত্তিতে ঈমানদার বলি? শাহাদার মাধ্যমে যে লিগাল ঈমান সেটার ভিত্তিতে। কিন্তু আল্লাহ আখিরাতে কিসের ভিত্তিতে ফয়সালা করবেন? প্রকৃত ঈমানের ভিত্তিতে, অন্তরের গহীনের ঈমান যা মানুষ দেখতে পায় না। আমাদের চারিপাশে এমনও অনেক মানুষ রয়েছে যাদের প্রকৃত ঈমান অনেক ওপরে কিন্তু আমরা জানি না, বুঝতে পারি না। এটা প্রকৃতই ঈমানের অবস্থা যা আমরা দেখি না।

 

অমুসলিমদের ব্যাপারে আমরা কি ভাবি? আল্লাহ এই আয়াতে দুটি দিকের কথা বলেছেন।

আল্লাহ বলেনঃ

(১) যে ব্যক্তি দিয়েছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে

(২) এবং ওয়া সাদ্দাকা বিল হুসনা

একদিকে প্রকৃত ঈমান এনেছে এবং এর ওপরে ওহী গ্রহণ করেছে।

 

এমন কি সম্ভব নয় যে, কেউ একজন হয়তো লিগাল ঈমান আনেনি কিন্তু ভেতরে প্রকৃত ঈমান রয়েছে? অবশ্যই থাকতে পারে। সে অমুসলিম হতে পারে কিন্তু তার ফিতরার বিষয়ও তো ভেতরের, আমরা তো সেটা জানি না, কীভাবে জাজ করবো তাকে? অথচ আমরা অনেকেই বলি যারা মুসলিম নয় তারা কাফির!! এটা বলা কি ঠিক? অবশ্যই না। লক্ষ্য করে দেখুন, আল্লাহর রাসূল যখন ইসলাম দিচ্ছেন, কয়টা ইসলাম দিচ্ছেন তিনি? একটা ইসলাম, একটা ধর্ম। সেই সময়ে আল্লাহর রাসূল ছিলেন চারিত্রিক দিক থেকে সর্বাপেক্ষা সেরা মানুষ, সেরা সাহাবা, সেরা চারিত্রিক গুণাবলীসম্পন্ন জেনারেশন। অর্থাৎ ইসলামের বার্তা ও যারা ইসলামকে উপস্থাপন করছিলো, দুটোই সেরা হতে হবে। এজন্যই আল্লাহর বার্তা দিয়েই কেবল পাঠাননি, তাকে বলেছেন “নিশ্চয়ই আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী”। অর্থাৎ বার্তা ও বার্তাবহনকারী উভয়ের বিশ্বস্থতা, প্রমাণ লাগবে।

কিন্তু আজকের দিনে কি ইসলামের উপরোক্ত দুটি বিষয়ের নয় বরং একটি বিষয় আকারে ইসলামের উপস্থাপন হচ্ছে? হ্যা। অনেক অমুসলিম-ই তো অভিযোগ করে বলতে পারে আমি ইসলামের ভেতরে যেমন দেখি একজন মুসলিমের মাঝে তা দেখি না। মুসলিমরা অলস, অফিসে দেড়িতে আসে, ঠিকমত কাজ করে না, মদ পান করে, অপরিচ্ছন্ন থাকে। তাহলে একজন অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণ না করার পেছনে আমাদের মন্দ দিকগুলোও তো দায়ী। অর্থাৎ আমাদের চারিত্রিক দিকগুলো ইসলামের সাথে যায় না আর এজন্য তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না, যে সমস্যা সাহাবাদের সময় ছিলো না।

সাহাবাদের সময়ে যারা ইসলাম অস্বীকার করেছে, তারা বার্তা ও বার্তাবাহকদের সকল গুণাবলী দেখার পরেই অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ ইসলাম কি সেটা কিতাব বা বার্তা ও বার্তাবাহক- উভয়ভাবেই দেখেছে ও ইসলামকে অস্বীকার করেছে পরিষ্কারভাবে দেখার পরে। তারাই প্রকৃতপক্ষে কাফের। কারণ তারা পরিষ্কারভাবেই ইসলাম দেখেছে এবং অস্বীকার করেছে।

কিন্তু আজকের দিনে পশ্চিমা বিশ্বে যারা আছে তারা বিবিসি, ফক্স, সিএনএন দেখে ইসলাম দেখেছে। তারা ইসলাম অস্বীকার করলে কি কাফের হয়ে যাবে? বা প্রকৃত ইসলাম না দেখলে, যা বিরোধীদের থেকে দেখেছে সেটার ভিত্তিতে ইসলামে না আসলে, অস্বীকার করলে কি কাফের হয়ে যাবে? তার উত্তর হলো না, তাকে কাফের বলা যাবে না। কারণ কাফের বা অস্বীকার তো তখন হবে যখন তাকে ইসলামের বার্তা, প্রকৃত বার্তা, পরিষ্কারভাবে, ইসলামের চারত্রিকগুণাবলীর সাথে দেওয়া হবে ও অস্বীকার করবে, তখনই না তাকে কাফের বলা হবে। আসলে সে তো প্রকৃত ইসলামের দাওয়াই পায় নি, সে কাফের হবেই বা কিভাবে?! তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি কিন্তু অস্বীকার কি করেছে? না। প্রকৃত ইসলাম পেলেই না অস্বীকারের কথা আসবে, কুফুরির কথা আসবে সে যা অস্বীকার করেছে সেটা তো ইসলাম-ই নয়, সেগুলো বিরোধীদের প্রোপাগান্ডায় ইসলামের বিকৃত রুপের বর্ণনা, সে তো সেই অস্বীকার করেছে। তারা তো প্রকৃত ইসলাম-ই দেখেইনি। একে তো আমরা কাফির বলতে পারি না, তাকে জাহান্নামে পাঠাতে পারি না। তার প্রকৃত ঈমানের অবস্থা আমরা জানি না।

আজকের দিনে মানুষ অনেকটাই বুদ্ধিবৃত্তিক মানবে পরিণত হয়েছে, অথচ এই বুদ্ধিবৃত্তিও অতোটা নয়। আর আধ্যাত্বিক বিষয়কে তো প্রায় ভুলেই গেছি। বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে একেকজনের একেক ধরণের থাকতে পারে। একজন একাডেমিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষক – এভাবে বিভিন্নজনের উপলব্ধির ভিন্নতা, প্রশ্ন ও জানার ভিন্নতার কারণে বুদ্ধিবৃত্তি দিক বিভিন্ন রকম হতে পারে। এভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়াবলী বিভিন্ন জনের জন্য বিভিন্ন হতে পারে। একজন কৃষক যে সাধারণ চিন্তা করে, তাকে বিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করার দরকার নেই। সে ঈমান এনেছে, নিয়মিত ইসলামের ফরজিয়াত ও অন্যান্য যা পারে তাই পালন করে। তাকে হাই লেভেলের বিজ্ঞানভিত্তিক ইসলাম দিয়ে আরো জটিলতায় ফেলানোর দরকার নেই। এভাবে আমাদের হাই লেভেলের চিন্তার উচ্চতা, সমস্যাগুলোকে একজন সাধারণ ব্যক্তির ভেতরে দিয়ে তাকে আরো ঝামেলায় ফেলতে পারি না।

অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক ঈমান কার সাথে চলবে, কার সাথে যাবে না- সেই লেভেল আপনাকে ভাবতে হবে। আপনাকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ধরণ অনুযায়ী ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলতে হবে। আজকের যুগে আমাদের অনেক বড় একটা সমস্যা (ক্রাইসিস) হলো ইসলাম একই লেভেলে এবং সবার কাছে এই একই লেভেলের বর্ণনা করা। আমরা মনে করি ঈমান একটি, এক লেভেলের, একই পন্থায় সবার কাছে বর্ণনা করা যাবে। আমরা যখন একজন সাধারণের কাছে কুরআনের কথা বাদ দিয়ে, আল্লাহর রাসূলের অনেক পরে আসা আকীদাগত বিভক্তির কথা বেশি বলি আর ঈমানের কথা কম বলি, সেগুলো অনেককেই ইসলামের নিকটে টানার বিপরীতে ইসলাম থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।

ঈমানের কথা যদি বলতেই হয় সাধারণভাবে কুরআন থেকেই বলুন না, ঈমানের জটিলতর বই থেকে বলতে হবে কেন? আর কারো যদি ধর্মতাত্ত্বিক হাই লেভেলের সমস্যা থাকে, তাহলে ঐ বিষয়ের ভিন্ন বই নেওয়া যেতে পারে। এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক ঈমানের বিষয়ে মনে রাখতে হবে।

কুরআনের সর্বাপেক্ষা পরিপক্ব ও পূর্ণাংগ ঈমানদার বলা হয়েছে যারা ‘উলুল আলবাব’ তাদেরকে। সূরা আলে-ইমরানে (১৯০) আল্লাহ বলেনঃ “নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টি আর দিবা-রাত্রির পরিবর্তনে উলুল আলবাব (সত্যিকার জ্ঞানবান)-দের জন্য নিদর্শন রয়েছে”।

এরা আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্ত্বিক উভয় দিকেই ঈমানের জন্য উৎসুক ছিল ওহীর নিকটে আসার পূর্বেই। অর্থাৎ তাদের ওহী আসার পূর্বেই ঈমানের উৎসুকতা তাদের ভেতরে বিরাজমান ছিল। কীভাবে? চলুন দেখি।

আল্লাহ বলেনঃ “নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টি আর দিবা-রাত্রির পরিবর্তনে উলুল আলবাব (জ্ঞানবান)-দের জন্য নিদর্শন রয়েছে”।

আল্লাহ বলতেছেন, আসমান, জমিন, দিন-রাত্রির পরিবর্তন – এগুলোর প্রত্যেকটির মাঝে অনেক সত্যিকার নিদর্শন (লাআয়াত) রয়েছে। আসমানে সৃষ্টিতে অনেক নিদর্শন রয়েছে, জমিনের সৃষ্টিতে অনেক নিদর্শন রয়েছে, দিন-রাত্রির পরিবর্তনে অনেক নিদর্শন রয়েছে পিউর জ্ঞানবানদের জন্য। অর্থাৎ এগুলোর প্রত্যকটির আলাদা আলাদা অনেক মু’জযাগত নিদর্শন রয়েছে। কাদের জন্য এই নিদর্শন? উলুল আলবাবদের জন্য, সবচেয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞানীদের জন্য।

এই উলুল আলবাব কারা? আল্লাহ তার পরের আয়াতেই উলুল আলবাবদের সংজ্ঞায়ন করেছেন।

“যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি বিষয়ে গভীর চিন্তা করে ” (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৯১)

উলুল আলবাবের সংজ্ঞায় কি কি বৈশিষ্ট এসেছে?

(১) যারা আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ করে

(২) যারা আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে

পূর্ববর্তী আয়াত কি বলেছে? আসমান-জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা ও দিবা-রাত্রির পরিবর্তন নিয়ে। এগুলোর প্রতি গভীর চিন্তা, এ বিষয়াবলীর দিকে তাকানো, এগুলো নিয়ে ভাবনা। তারা কিন্তু কিতাব পড়তেছে না, ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করতেছে না, তারা তাদের চারিপাশের সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেছে; বিশেষত আল্লাহর কাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। পরবর্তী আয়াতে উলুল আলবাবদের দুটি গুণ বলা হয়েছে (১) সর্বদা আল্লাহর স্মরণ (২) সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা। এভাবে আল্লাহর স্মরণ আধ্যাত্বিক চর্চা আর সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। এভাবেই আল্লাহ বুঝাতে চাচ্ছেন যে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা আমাদেরকে আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় ধরণের খোরাক দেবে। দিবা-রাত্রি পরিবর্তনের চিন্তা আপনাকে কাদাতে পারে, আসমান-জমিনের সৃষ্টির চিন্তা আপনাকে গভীরভাবে আন্দোলিত করতে পারে। এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনার জীবনকে বাস্তবতার দিকে নিয়ে যাবে।

উস্তাদ নুমান আলী খান এখানে তার এক সিনিয়র ভাই এর কথা উল্লেখ করেন। তারা দুজনেই বিমানে যাচ্ছিলেন এবং উস্তাদ নুমানকে একদম চুপ করতে বললেন, সে যেন তার সাথে আর কথা না বলে। যেহেতু তার সিনিয়র ভাই দর্শন, বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে পড়াশুনা করছিলো তাই তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছিলেন যে আসলেই যে এগুলো আল্লাহর সৃষ্টির চিন্তার গভীরতা তাঁর দিকেই নিয়ে যায় কিনা। তিনি একটানা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে, তারকার দিকে বিরতিহীণভাবে দুই ঘন্টা তাকিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলেন। তিনি নতুনভাবে উজ্জীবিত হলেন, চিন্তার প্রচ্ছন্নতা তাকে গভীরতর মুসলিম হিসেবে আগমন ঘটালো।

চিন্তা করুন, গভীরভাবে চিন্তা করুন। আকাশ নিয়ে গভীরতায় মেতে থাকুন, চলমান মেঘের দিকে তাকিয়ে চিন্তাশীল হউন, সমুদ্র নিয়ে ভাবুন। এগুলো নিয়ে ভাবুন, আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তা করুন। এগুলোর অস্তিত্ব, কীভাবে এলো, কীভাবে আমাদের জীবজগত ও আমাদের জীবনের খাদ্য ও আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। চিন্তা করুন, নিজেই এক্সপেরিয়েন্স করুন চিন্তার গভীরতার মধ্য দিয়ে। মনে রাখুন এই চিন্তাশীল লোকেরাই আল্লাহর অধক প্রিয়, সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ জ্ঞানী সম্প্রদায়, উলুল আলবাব।

সময় বের করুন, সকালে হাটুন, আকাশের দিকে তাকান, পরিবেশের দিকে তাকান, চারিদিকের প্রাকৃতিক জিনিসের দিকে গভীর দৃষ্টি দিন। এই চিন্তাগুলো আপনার ঈমানকে রিফ্রেশ করবে, সতেজ করবে। এগুলোর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর স্মরণ করে আধ্যাত্বিক চর্চা করবেন আবার সৃষ্টির সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ সুনিপুন শৃঙ্খলা আপনার চিন্তাশীলতার গভীরতায় নিয়ে যাবে যা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে জীবন্ত করবে, গভীরতর করবে। আর এসব লোকেরাই তখন এসব সৃষ্টির সুনিপুনতা দেখে, এদের সুশৃংখলাময় ভারসাম্য দেখে মুখ দিয়ে অপকটে বলে উঠেঃ “হে আমাদের রব, আপনি এসবের কোনো কিছুই অযথা সৃষ্টি করেন নি। আপনি অযথা সৃষ্টির অনেক উর্ধে, আপনি সকলক্রুটি থেকে মুক্ত অতএব আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন” (সূরা আলে-ইমরান, ১৯১)

গভীর চিন্তাশীলতার গুরুত্ব এখানেই। তারা গভীর চিন্তা করেই বুঝতে পারলো যে এসব সৃষ্টির কোনো কিছুই অযথা বা উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেন নি। যার অর্থ হলো আমাকেও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। আমাকে যদি উদ্দেশ্য করেই সৃষ্টি করা হয় তবে আমি যা করি এসবেরও হিসাব দিতে হবে, আমিই আমার কর্মের দায়িত্ব নেবো। আর তাই আমি জাহান্নামে যেতে চাই না। এমনও শাস্তি থাকতে পারে যেগুলোর ব্যাপারে আমরা জানি না। আর এগুলোই রাসূল এসে বলে দিয়েছেন আর আমরাও এসব আহবানকারীদের আহবানে সারা দিয়ে ঈমান আনলাম।

“হে আমাদের রব, আমরা আহবানকারীর ঈমান আনয়নের আহবান শুনলাম, ঈমান আনলাম” (সূরা আলে-ইমরান, ১৯৩)

লক্ষ্য করে দেখুন এই এখন মাত্র তারা ঈমান আনল, অর্থাৎ লিগাল বা আইনগত ঈমানে প্রবেশ করলো। অন্য কথায় লিগাল ঈমানে তারা পরে প্রবেশ করেছে, তাঁর আগেই তাদের ভেতরে প্রকৃত ঈমান বিদ্যমান ছিল ছিল!!

তাঁর মানে তারা আগেই সজ্ঞানের সাথে সবকিছুকেই আল্লাহর বলে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছিল গভীর চিন্তাশক্তির মাধ্যমে, এখন যখন ইসলামের দাওয়াত তাদের কাছে পৌছানো হলো তখন তারা শাহাদার মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার জন্য প্রবেশ করলো লিগাল ঈমানে।

“সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, দোষসমূহকে আবৃত করুন, আর পুণ্যবানদের সাথে আমাদের মৃত্যু দান করুন” (সূরা আলে-ইমরান, ১৯৩)

অর্থাৎ এখান থেকেই বুঝতে পারি আমাদের দৃঢ় ঈমানদার হতে গেলে, সত্যিকার গভীর ও শক্তিশালী মুমিন হতে গেলে, বিশুদ্ধতম জ্ঞানবান মুমিন হতে গেলে আমাদেরকে আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় ধরণের ঈমানই লাগবে। যেরুপভাবে আমদের শরীর ও আত্মার জন্য ভারসাম্য দরকার, তেমনি আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঈমানেরও ভারসাম্য দরকার সত্যিকার জ্ঞানবান গভীরচিন্তার ঈমানদার হতে গেলে। আর এক্ষেত্রে সৃষ্টি বিষয়ে গভীর পড়াশুনা, দেখা, চিন্তা করা আর সর্বদা আল্লাহর স্মরণ কতটা প্রয়োজনীয় সেটা আল্লাহর আয়াতসমূহের মাধ্যমেই বুঝতে পারি।

 

ভাব সারাংশ করা হয়েছে উস্তাদ নুমান আলী খানের বাইয়্যিনাহ টিভির “Quran and The Journey of Faith” থেকে।

Abdun Nasir